দৌলত রহমান,গুয়াহাটিঃ
চিকিৎসা বিজ্ঞানে গবেষণা ও অগ্রগতির জন্য মৃত্যুর পর মৃতদেহ দানকারী দেশের প্রথম মুসলিম দম্পতি—আফতাব আহমেদ ও মুছফিকা চুলতানা ।অসমের আফতাব আহমেদ এবং মুছফিকা চুলতানা, তাদের কন্যা লুবনা শ্বাহিন এখন পিতামাতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাদের ধারাবাহিকতায় চলতে সংকল্পবদ্ধ। মৃত্যুর পর মৃতদেহ দান করার মাধ্যমে চিকিৎসা বিজ্ঞানের গবেষণা ও অগ্রগতিতে অবদান রাখার জন্য ইতিহাসে এক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছিলেন।
তাদের এই অনন্য দান, মুসলিম সমাজে যেখানে শারীরিক এবং অঙ্গদান বিষয়ে সচেতনতা এখনো কম, সেখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা প্রদান করেছে। ধর্মীয় বিশ্বাস এবং আগ্রহের অভাবে অনেকেই আজও এই বিষয়ে পিছিয়ে, কিন্তু এই দম্পতির মৃত্যু পরবর্তী দেহদান সমাজের সকল স্তরের মানুষের প্রশংসা পেয়েছিল।
লুবনা শ্বাহিনের সংকল্প
আফতাব আহমেদ ও মুছফিকা চুলতানার কন্যা লুবনা শ্বাহিন এখন তার পিতামাতার উত্তরাধিকারকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সংকল্প নিয়েছেন। যদিও একাংশ আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধুবান্ধব তাদের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে লুবনাকে এই পদক্ষেপে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, তবুও লুবনা দৃঢ়ভাবে নিজের সিদ্ধান্তে অটল রয়েছেন।
‘আওয়াজ-দ্যা ভয়েজ’ এর সাথে এক সাক্ষাৎকারে লুবনা শ্বাহিন বলেন, “আমি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান যে আমি একটি প্রগতিশীল মুসলিম পরিবারে বড় হয়েছি। ইসলামে বিশ্বাসী হলেও, আমাদের পরিবার কখনও ধর্মীয় গোঢ়ামিকে প্রশ্রয় দেয়নি এবং সবসময় যুক্তি সহকারে প্রতিটি দিক বিবেচনা করেছে।”
মা-বাবার মানবসেবা ও দেহদান: লুবনা শ্বাহিনের অন্তর্দৃষ্টি
"আমার মা-বাবা দুজনেই বিভিন্নভাবে মানুষের সেবা করেছেন এবং জীবন কাটিয়েছেন। মৃত্যুর পরও তারা তাদের শরীর ও চোখ দান করেছেন। মানুষের সেবা করার প্রতি তাদের যে দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, তার কারণেই তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। যদি তারা ক্যান্সারে আক্রান্ত না হতেন, তাহলে আরও অনেক অঙ্গ দান করতে পারতেন। তবুও তারা যতটুকু সম্ভব ভালো কাজ করেছেন। কলেজে পড়াশোনা করার সময় আমি রক্তদান শিবিরে অংশ নিয়েছিলাম, এবং যখন আমি এই বিষয়টি আমার মা-বাবাকে বললাম, তারা আমাকে পুনরায় রক্তদান করতে উৎসাহিত করেছিলেন। যদিও আমি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে অঙ্গ বা শরীর দান করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়নি, তবুও আমি খুব শিগগিরই এটি করার পরিকল্পনা করছি।" - লুবনা শ্বাহিন
মানবতার পুজারী ও পুত্র
ধর্মীয় বাধা সত্ত্বেও এক মানবিক পদক্ষেপ
লুবনা শ্বাহিনের এই সিদ্ধান্ত শুধু তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি নয়, বরং তার পরিবার, বিশেষত মা-বাবার আদর্শের এক অন্তর্দৃষ্টি। মুছলমান সমাজে, যেখানে শরীর ও অঙ্গ দানের বিষয়ে সচেতনতা এখনও তুলনামূলকভাবে কম, সেখানে এমন একটি মানবিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ ছিল না। তবে, লুবনা ও তাঁর বড় বোন নিনন শ্বেনাজ পিতামাতার মৃতদেহ গুয়াহাটি মেডিকেল কলেজ এণ্ড হস্পিতাল (জি এম চি এইচ)-কে দান করার সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
এটি কোনো সহজ পদক্ষেপ ছিল না, বিশেষত মুসলিম সমাজের ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে, কিন্তু তারা মনে করেছিলেন—এটি মানুষের কল্যাণের জন্য একটি মহৎ কাজ, এবং চিকিৎসা বিজ্ঞান ও গবেষণার ক্ষেত্রে একটি অপরিসীম অবদান।
লুবনা শ্বাহিনের এই মানবিক চেতনা ও সমাজের প্রতি দায়িত্বশীলতা, তার পিতা-মাতার আদর্শকে সামনে নিয়ে আসছে। তাদের জীবন ও দানে মানবতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি, লুবনা আজও সেই পথ অনুসরণ করে সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে আগ্রহী।
লুবনা শ্বাহিনের অভিজ্ঞতা
মা-বাবার মৃতদেহ দান এবং সমাজের বাধা"যেদিন আমার বাবার মৃতদেহ চিকিৎসালয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, সেদিন অনেক মানুষ আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল যে তার মৃতদেহ কবরে দাফন করা উচিত ছিল, তবে আমরা কেন তাকে দান করছি, তা তাদের পক্ষে বুঝতে পারছিলেন না। তবুও, আমার বাবা এই বাধার কথা আগে থেকেই অনুমান করেছিলেন এবং সে কারণে তিনি একটি স্পষ্ট ইচ্ছাপত্র রেখে গিয়েছিলেন। যেখানে তিনি তার সিদ্ধান্ত সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন। আমার মায়ের ক্ষেত্রে পরিবার থেকে কোনো প্রাথমিক বাধা আসেনি, তিনি মৌখিকভাবে তার ইচ্ছা জানিয়েছিলেন। তবুও, আমাকে মুসলিম পরিবার এবং বন্ধু-বান্ধবীদের পরামর্শকে ঠেকাতে হয়েছিল, যারা আমাকে ফোন করে মায়ের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বলেছিল। তারা বলেছিল, যদি মাকে কবরে না রাখা হয়, তবে তিনি জান্নাতে যেতে পারবেন না এমন একটি কঠোর মন্তব্য তারা করেছিলেন। তবে একই সময়ে, আমরা অন্য মুসলিম বন্ধুদের কাছ থেকে এমন কিছু বার্তা পেয়েছিলাম, যারা মায়ের এবং বাবার এই সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়েছিল।" লুবনা শ্বাহিন ।
দেহদান করার নজির রেখেছেন
সমাজের বাঁধা ও সাহসী পদক্ষেপ লুবনা শ্বাহিনের অভিজ্ঞতা সমাজের সেই ধরনের মানসিকতা ও ভ্রান্ত ধারণাকে সামনে নিয়ে আসে, যেখানে মৃতদেহের দান বা অঙ্গদান গ্রহণ করা এখনও অনেকের জন্য এক অস্বাভাবিক বা ভুল সিদ্ধান্ত মনে হয়। মুর্খতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, লুবনা এবং তার পরিবার এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে এক উদাহরণ স্থাপন করেছেন, যা শুধুমাত্র মুসলিম সমাজের মধ্যে নয়, পুরো পৃথিবীজুড়ে মানবিকতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সাহায্য করেছে।
এইটি শুধু একটি পরিবার বা ব্যক্তির অভিজ্ঞতা নয়, বরং এটি সমাজের যে সমস্ত রক্ষণশীল মনোভাবের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী বার্তা, যে মানবতার কল্যাণের জন্য প্রতিটি সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ। লুবনা শ্বাহিনের সাহসিকতা এবং মানবিকতার এই প্রদর্শন সমাজের প্রগতির পক্ষে এক শক্তিশালী উদাহরণ।
অঙ্গ দান করে সামাজিক রীতি ভেঙ্গে দেন
আফতাব আহমেদ ও মুছফিকা চুলতানার অঙ্গ দান: মৃত্যুর পরেও মানবতার সেবায়
২০২২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর, গুয়াহাটির হাতীগাঁওয়ের মাজার রোডের বাসিন্দা মুছফিকা চুলতানা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর তার দুটি চোখ শ্রীশংকরদেব নেত্রালয়ে দান করা হয়েছিল। মুছফিকার স্বামী আফতাব আহমেদও ২০১১ সালে গুয়াহাটির মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতাল (জিএমসিএইচ)কে তার দেহ দান করেছিলেন।
মুছফিকা চুলতানা ও আফতাব আহমেদের এই মানবিক পদক্ষেপ শুধু তাদের সন্তানদের জন্যই নয়,বরং পুরো সমাজের জন্য একটি অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের সন্তান লুবনা শ্বাহিন এবং নিনন শ্বেনাজ আজ গর্বিত যে,তাদের মা-বাবা মৃত্যুর পরও সমাজের কল্যাণে অবদান রেখে গেছেন।লুবনা শ্বাহিন বলেন, "আমি অত্যন্ত আশাবাদী যে,আমি এবং আমার বোন আমাদের মা-বাবার এই মহৎ পরম্পরাকে এগিয়ে নিয়ে যাব।"
একটি অনুপ্রেরণামূলক পরম্পরা মুছফিকা চুলতানা এবং আফতাব আহমেদের দেহদান শুধু তাদের সন্তানদের জন্য নয়, সমাজের অন্যান্য সদস্যদের জন্যও এক মহান বার্তা। এই পরম্পরাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য লুবনা শ্বাহিনের দৃঢ় সংকল্প এবং তার মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি সমাজের জন্য এক উজ্জ্বল উদাহরণ।এই পরিবারটির সিদ্ধান্ত মানবতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং সমবেদনা প্রকাশ করে,যেখানে তারা মৃত্যুর পরেও মানুষের উপকারে আসতে চেয়েছেন। এই দৃষ্টান্তটি সমাজে অঙ্গদান ও দেহদান বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে এবং মানবিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সহায়ক হবে।
লুবনা শ্বাহিনের প্রতিক্রিয়া: প্রধানমন্ত্রী মোদির আহ্বান ও অঙ্গদান। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দেশের জনগণকে জীবন রক্ষার্থে অঙ্গদান করার আহ্বান জানিয়েছেন। তার এই আহ্বানের প্রতি প্রতিক্রিয়া জানিয়ে লুবনা শ্বাহিন বলেন,"আমি মনে করি যে, প্রধানমন্ত্রী মোদীর মতো একজন প্রভাবশালী নেতা যখন এমন একটি আহ্বান জানাচ্ছেন, তখন এর গুরুত্ব অনেক বেশি। কারণ, তার দেশের প্রতি ব্যাপক প্রভাব এবং জনপ্রিয়তা রয়েছে। আমি আশা করি যে, এক দশক বা তারও বেশি সময় পরে, হয়তো দেহ বা অঙ্গদান একটি সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য প্রথা হয়ে উঠবে।"
সমাজে অঙ্গদান বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি লুবনা শ্বাহিনের এই মন্তব্য প্রমাণ করে যে, সামাজিক প্রথা ও মানসিকতার পরিবর্তন আসতে সময় লাগে। তবে,প্রধানমন্ত্রী মোদীর মতো একজন জাতীয় নেতা যখন এই ধরনের আহ্বান করেন, তখন তা সমাজে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও সচেতনতার সৃষ্টি করতে পারে। আশা করা যায় যে, ভবিষ্যতে অঙ্গদান ও দেহদান আরও বেশি সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে এবং এটি মানুষের জীবন রক্ষায় আরও বেশি ভূমিকা রাখতে পারবে।