পিতা-মাতা জন্মদাতা, শিক্ষক জ্ঞানের দাতা। শিক্ষক ত্যাগের প্রতীক এবং সাধনার রূপ। ত্যাগ ও সাধনার প্রতীক এই শিক্ষক সমাজের প্রতিটি কোণকে আলোকিত করেন। শিক্ষক হলেন জ্বলন্ত প্রদীপ, যার আলোয় জ্বলে ওঠে হাজারো প্রদীপ। জ্ঞানের মন্দিরের শিক্ষক হলেন একান্ত উপাসক। শিক্ষাগুরুর জ্ঞানের বেদীতে প্রতিনিয়ত উচ্চারিত হয় মানব সম্পদ গড়ার অমোঘ মন্ত্র। বিদ্যালয়ে অবস্থানের সময়ই শিক্ষকের দায়িত্ব শেষ হয় না, প্রতিটি মুহূর্তে শিক্ষকের ভূমিকা অপরিসীম। আজ শিক্ষক দিবসের এই প্রতিবেদনে আমরা এমনই একজন শিক্ষকের কথা বলছি, যিনি ছাত্র-ছাত্রীদের শুধু পাঠদানেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। পাঠ্যশিক্ষার পাশাপাশি ছাত্র-ছাত্রীদের সাংস্কৃতিক, বৌদ্ধিক ও মানসিক বিকাশেও গুরুত্ব দিয়ে আসছেন।
শিক্ষকের নাম এম. হাফিজ আলি। ১৯৬৬ সালে ওদালগুড়ি জেলার কলাইগাঁওয়ের শিঙিরীমারী টাউনে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। শৈশবে পিতৃহারা হয়ে সিপাঝারের ঐতিহাসিক মারৈ গ্রামে মামার বাড়িতে থেকে পড়াশোনা শুরু করে উচ্চশিক্ষা সম্পূর্ণ করেন এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। বর্তমানে তিনি সিপাঝারের মারৈ-বিজুলীবাড়ি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর থেকে তিনি এই বিদ্যালয়েই শিক্ষকতা করছেন। ছাত্র-ছাত্রীদের বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাবে পাঠদানের পাশাপাশি মানসিক, সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক বিকাশে তাঁর পদক্ষেপ অনন্য। তাঁর নেতৃত্বে বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকারা পাঠক্রমের বাইরে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে গিয়ে বিদ্যালয়টিকে এক বিশেষ পরিচিতি দিতে সক্ষম হয়েছেন।
তাঁর নেতৃত্বে প্রতি শনিবার বিদ্যালয়ে পাঠশেষে ছাত্র-ছাত্রীদের লুকিয়ে থাকা প্রতিভা প্রকাশের জন্য “শনিবারীয়া চ'রা” (শনিবারের আড্ডা) নামে এক বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। এখানে ছাত্র-ছাত্রীরা নৃত্য, আধুনিক গান, বিহু নৃত্য, জিকির,দরং অঞ্চলের বিখ্যাত নাঙলী গান, অভিনয়, বক্তৃতা, কুইজ,ক্যারাটে ইত্যাদি পরিবেশন করে। পাশাপাশি প্রতি বছরের শিক্ষক দিবসে প্রতিটি শ্রেণী থেকে হাতে লেখা পত্রিকা প্রকাশ করে আসছে ছাত্র-ছাত্রীরা, যা তাঁর তত্ত্বাবধানে গত ১০ বছর ধরে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে।
তাঁর পরিচালনায় বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা রাজ্য ও জেলা পর্যায়ের নানা প্রতিযোগিতায় পুরস্কৃত হয়েছে। ২০১৯ সালে আসামে অনুষ্ঠিত ৬ষ্ঠ শিশু সুরক্ষা দিবসের স্মরণোৎসবে নাঙলী গান পরিবেশনের জন্য বিদ্যালয় পুরস্কৃত হয়। ২০২৪ সালে SHIF নামক একটি এনজিও আয়োজিত মডেল প্রস্তুত প্রতিযোগিতায় দরং জেলায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
“আওয়াজ-দ্য ভয়েস”-এর এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমার জীবনের লক্ষ্যই ছিল শিক্ষক হওয়া। ছাত্রজীবন থেকেই আমি শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। একজন ছাত্রের জন্য শিক্ষকই আদর্শ। আমার শিক্ষকরাই আমার আদর্শ ছিলেন। শিক্ষক হব বলে ভাবার পর আর কখনো অন্য পেশায় যুক্ত হওয়ার কথা ভাবিনি। আল্লাহ/ভগবান আমাকে সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করেছেন। একজন শিক্ষক যদি কেবল চাকরি করার মানসিকতা রাখেন, তবে তিনি প্রকৃত শিক্ষক হতে পারবেন না। শিক্ষকতা হলো মানব সম্পদ গড়ার পেশা।”
তিনি আরও বলেন, “একজন শিক্ষক সর্বজ্ঞানী হওয়ার চেষ্টা করবেন এবং তাঁর কোনো নির্দিষ্ট সময় থাকে না। তিনি সর্বদাই শিক্ষক। বিদ্যালয়ের পাঠদানই শুধু শিক্ষকতা নয়, সমাজ জীবনের সঙ্গে যুক্ত থেকেও জ্ঞান আহরণ করতে হবে। ছাত্রছাত্রীরা যদি কোনো বিষয় জিজ্ঞাসা করে আর আমি না জানি, এটা শিক্ষকের গুণ হতে পারে না। তাই শিক্ষককে সর্বদা অধ্যয়নশীল হতে হবে।”
বর্তমান প্রজন্মের অনেক শিক্ষককে তিনি কেবল চাকরিজীবী হিসেবে দেখেন, যাদের ছাত্রদের শারীরিক, মানসিক ও বৌদ্ধিক বিকাশে ভূমিকা কম। তিনি নতুন শিক্ষকদের প্রতি আহ্বান জানান, শিক্ষকতাকে যেন কেবল আয়ের পথ হিসেবে না দেখে মহৎ পেশা হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
অনলাইন ও শ্রেণিকক্ষ শিক্ষার পার্থক্য নিয়ে তিনি বলেন, “স্মার্ট ক্লাসরুম এখন সরকারি স্কুলেও দেওয়া হচ্ছে। তবে অনলাইন শিক্ষা কখনো শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার সমতুল্য হতে পারে না। কারণ, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক দুর্বল থেকে মেধাবী ছাত্রদের আলাদা করে চিনে সেই অনুযায়ী শিক্ষা দেন। অনলাইনে তা সম্ভব নয়। তবে ডিজিটাল যুগে অনলাইন শিক্ষারও প্রয়োজন আছে, কিন্তু সরাসরি উপস্থিত থেকে শিক্ষাদান সর্বোত্তম।”
উল্লেখযোগ্য যে, ছাত্রজীবন থেকেই সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা করে আসা হাফিজ আলি বহু গ্রন্থ রচনা ও সম্পাদনা করেছেন। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে, মহাজীবন আজান ফকির আর বৰ্তমান, গরীয়া জনগোষ্ঠীর সভ্যতা ও সংস্কৃতি। তিনি সম্পাদনা করেছেন, এম কন্তুম আলির জীবন ও সৃষ্টি, অতুল চন্দ্ৰ দাসের জীবন,দরঙের লোকাচার , বিভিন্ন স্মৃতিগ্রন্থ ও সাহিত্য সভার পত্রিকা। সাহিত্য একাডেমিতেও গবেষণাপত্র পাঠ করেছেন।
তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘উয়ে পোতা বলিশাল’, যা গরীয়া জনগোষ্ঠীর মহীরূহ পশুর জীবনকাহিনীর ওপর ভিত্তি করে রচিত।
শিক্ষাজীবনের পাশাপাশি সমাজজীবনের নানা কর্মকাণ্ডেও তিনি যুক্ত। এজন্য তিনি বহু পুরস্কার পেয়েছেন, যেমন, ভারতীয় দলিত সাহিত্য পরিষদের ড. আম্বেদকর ফেলোশিপ জাতীয় পুরস্কার, ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র ফেলোশিপ, অসম সরকারের রাজ্য কৃতি শিক্ষক পুরস্কার, আরোহণ সাহিত্য রত্ন পুরস্কার প্রভৃতি।
শিল্প-সংস্কৃতির জগতেও তাঁর সক্রিয়তা সমানভাবে লক্ষণীয়। সংগীতে তিনি নিয়মিত জিকির শিল্পী, নাটকে অভিনয় ও পরিচালনাতেও তাঁর সাফল্য আছে। এছাড়া তিনি আজান ফকির সাহেব, সাত নম্বরের সন্ধানে চলচ্চিত্রে এবং শুভ বিবাহ, স্বপ্ন ভঙ্গ ধারাবাহিকে অভিনয় করেছেন।
শিক্ষক দিবস প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “প্রতি বছর শিক্ষক দিবসে আমি আমার এক শিক্ষকের বাড়িতে যাই। এতে তিনি খুব আনন্দ পান। আমরা যেসব শিক্ষকদের হারিয়েছি তাঁদের প্রতিও সকালেই শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাই। শিক্ষক দিবস আমার কাছে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ উৎসব।”