গৌরবের ছায়ায় লুকানো এক নায়ক: 'ফার্স্ট সেবক অফ হিন্দ' আবদুল হাবিবের ত্যাগময় জীবনগাথা

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 20 d ago
মেমন আবদুল হাবিব ইউসুফ মারফানি, 'ফার্স্ট সেবক অফ হিন্দ'
মেমন আবদুল হাবিব ইউসুফ মারফানি, 'ফার্স্ট সেবক অফ হিন্দ'
 
আর্সালা খান

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন অসংখ্য ত্যাগ ও বলিদানের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। ইতিহাসে বহু মহান ব্যক্তিত্বের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে, কিন্তু এমন অনেক অজানা সৈনিকও ছিলেন, যাদের অবদান ছাড়া এই সংগ্রাম অসম্পূর্ণ থেকে যেত।
 
এমনই এক মহান মানুষ ছিলেন মেমন আবদুল হাবিব ইউসুফ মারফানি, যিনি তাঁর ত্যাগ, সেবা এবং নিষ্ঠার জন্য “ফার্স্ট সেবক অফ হিন্দ” উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন।
 
মেমন আবদুল হাবিব ইউসুফ মারফানি
 
প্রাথমিক জীবন ও পটভূমি
 
মেমন আবদুল হাবিব ইউসুফ মারফানির জন্ম হয় একটি মেমন ব্যবসায়ী পরিবারে। মেমন সম্প্রদায়কে গুজরাট ও সিন্ধ অঞ্চলের সঙ্গে সম্পর্কিত মনে করা হয়, যারা ব্যবসায়িক সমৃদ্ধির পাশাপাশি সমাজসেবা ও দানশীলতার জন্য সুপরিচিত। এই পরিবেশেই আবদুল হাবিবের মধ্যে দেশপ্রেম ও সেবার গভীর বোধ গড়ে ওঠে।
 
স্বাধীনতা আন্দোলনে অবদান
 
অবদুল হাবিব গান্ধীজির আদর্শ ও আন্দোলনে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তিনি অসহযোগ আন্দোলন, লবণ সত্যাগ্রহ এবং বিদেশি পণ্যের বর্জন – এইসব কর্মসূচিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, স্বাধীনতা মানে শুধুই রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তন নয়, বরং তা ভারতীয় সমাজের নবজাগরণের পথ।
তাঁর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল যে তিনি নিজেকে সবসময় "সেবক" বলে পরিচয় দিতেন। তাঁর কাছে নেতৃত্বের অর্থ ছিল জনগণের সেবা করা এবং জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ স্থানে রাখা। এই কারণেই তিনি “ফার্স্ট সেবক অফ হিন্দ” নামে পরিচিতি লাভ করেন।
 
গয়নার ত্যাগের গাথা
 
আবদুল হাবিবের নিষ্ঠা ও ত্যাগের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হল তাঁর স্ত্রীর গয়নার সঙ্গে জড়িত এক ঘটনা। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়, যখন আন্দোলনের জন্য অর্থের প্রয়োজন ছিল, তখন তিনি নিজের ঘরকেই সমর্থনের কেন্দ্র করে তোলেন। তিনি তাঁর স্ত্রী (ভিবি)-কে বলেছিলেন, "এখন সময় এসেছে দেশের জন্য সবকিছু উৎসর্গ করার।" স্ত্রীও বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে নিজের সমস্ত গয়না খুলে তাঁর হাতে তুলে দেন।
 
আবদুল হাবিব সেই গয়না বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থ আন্দোলনের তহবিলে প্রদান করেন। এটি শুধু অর্থনৈতিক সাহায্য ছিল না, বরং সেই ত্যাগ সেই সময়ের প্রতিটি ভারতীয়ের কাছে এক উদাহরণ হয়ে ওঠে, যে স্বাধীনতার জন্য ব্যক্তিগত সুখ-সুবিধা ত্যাগ করাই সর্বোচ্চ ধর্ম।
 
কেন তাঁকে বলা হয় ‘ফার্স্ট সেবক অফ হিন্দ’?
 
নিস্বার্থ সেবা: তিনি কখনও পদ, ক্ষমতা বা খ্যাতির লালসা রাখেননি।
 
ব্যক্তিগত ত্যাগ: নিজের ব্যবসা ও পারিবারিক সম্পত্তির চিন্তা না করে আন্দোলনের জন্য সবকিছু উৎসর্গ করেন।
 
গয়নার ঘটনা: স্ত্রীর গয়না পর্যন্ত আন্দোলনের জন্য দান করে দেওয়া তাঁর ত্যাগের এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে।
 
সর্বধর্ম সমভাব: মুসলিম সম্প্রদায়ের হলেও, তিনি কখনও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করেননি এবং নিজেকে সর্বদা "ভারতীয়" হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। 
 
সেবকের ভাবনা: তাঁর জীবনদর্শনই ছিল যে তিনি "হিন্দ" অর্থাৎ ভারতের একজন সেবক।
 
নেতাজী সুভাস চন্দ্র বোস ও আজাদ হিন্দ ফৌজের সদস্যরা -১৯৪০
 
ঐতিহ্য ও স্মরণ
 
স্বাধীনতা লাভের পর তাঁর নাম অন্যান্য বড় নেতাদের মতো বহুল প্রচারিত হয়নি, কিন্তু যাঁরা তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন, তাঁদের হৃদয়ে তিনি আজও “সত্যিকারের সেবক” হিসেবে বেঁচে আছেন। তিনি নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন যে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুধু যুদ্ধ বা আন্দোলন নয়, বরং তা ছিল সেবা, ত্যাগ ও বিশ্বাসের মিলনস্থল।
 
মেমন আবদুল হাবিব ইউসুফ মারফানির জীবন আমাদের শেখায় যে স্বাধীনতার আসল শক্তি শুধু বড় নেতাদের মধ্যে ছিল না, বরং সেই অগণিত সেবকদের মধ্যে নিহিত ছিল, যাঁরা তাঁদের সুখ-সুবিধা, সম্পত্তি এবং এমনকি নিজের পরিবার পর্যন্ত উৎসর্গ করেছিলেন।
 
তাঁর স্ত্রীর গয়নার সেই ঘটনা আজও ত্যাগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গাথা হিসেবে গণ্য করা হয়। “ফার্স্ট সেবক অফ হিন্দ” বলা মানে শুধু একটি উপাধি নয়, বরং তাঁর জীবনের প্রতিটি দিকের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো ,যা তাঁকে ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে এক অমর ও অনুপ্রেরণামূলক নায়ক করে তোলে।