পল্লব ভট্টাচার্য
অসমে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিজ্ঞান শাখায় ছাত্রছাত্রীদের নামভর্তি আশঙ্কাজনকভাবে কমে এসেছে, যা রাজ্যের শিক্ষার মান ও ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থানের দিক থেকে এক গুরুতর সতর্কসংকেত। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে অসমে একাদশ শ্রেণিতে মাত্র ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হয়েছে, যেখানে অন্ধ্র প্রদেশের মতো রাজ্যে এই হার ৭০ শতাংশেরও বেশি।
রাজ্যের বিদ্যালয়গুলিতে মোট ভর্তি হার ৬ শতাংশ কমে যাওয়া শুধুমাত্র জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত নয়, বরং আকাঙ্ক্ষার সংকটেরও লক্ষণ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, তথ্যবিজ্ঞান, রোবোটিক্স এবং জৈবপ্রযুক্তি দ্বারা চালিত এক যুগে বিজ্ঞানের প্রতি এমন অনীহা গোটা এক প্রজন্মকে প্রযুক্তিনির্ভর ভবিষ্যতের সম্ভাবনাময় কর্মক্ষেত্র থেকে পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি করছে। বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়ার কারণগুলো বহুস্তরীয়। বিদ্যালয় পর্যায়ে কার্যকর পরীক্ষাগারের অভাব, প্রশিক্ষিত শিক্ষক এবং আকর্ষণীয় শিক্ষণপদ্ধতির ঘাটতির কারণে তরুণ প্রজন্মের মনে বিজ্ঞানের প্রতি যে উচ্ছ্বাস ছিল, তা ক্রমে ম্লান হয়ে পড়েছে।
প্রতীকী ছবি
গুয়াহাটির উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলিতে পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, মাত্র এক-তৃতীয়াংশ বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান গবেষণাগার আছে এবং এক-চতুর্থাংশেরও কম শিক্ষক ল্যাব ম্যানুয়ালের যথাযথ ব্যবহার করতে পারেন। যেখানে যন্ত্রপাতি আছে, সেখানে তা প্রায়ই ভাঙা কাচের সামগ্রী, দুর্বল রক্ষণাবেক্ষণ বা নিরাপত্তার অভাবে অকেজো অবস্থায় পড়ে থাকে। ফলে বিজ্ঞান শিক্ষার মূলভিত্তি, ব্যবহারিক শিক্ষা, অবহেলিত হচ্ছে।
বিজ্ঞান শাখায় উত্তীর্ণের হারও ক্রমশ কমছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটি ৯২ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ৮৫ শতাংশে, যা শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতির অভাব এবং শিক্ষকদের ক্লান্তি- উভয়কেই প্রতিফলিত করে। অনেক শিক্ষক পর্যাপ্ত সহায়ক কর্মী ছাড়াই ল্যাবে ক্লাস নিতে বাধ্য হন, ফলে তাঁদের মনোবল ভেঙে যায়, আর তাতে শিক্ষার্থীদের কৌতূহলও হ্রাস পায়। বিজ্ঞানসম্মত পরিবেশের অভাবে ছাত্রছাত্রীরা তাই কলা বা বাণিজ্য বিভাগ বেছে নিচ্ছে।
এই প্রবণতার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। আগামী দশকগুলোতে প্রযুক্তি ও তথ্যনির্ভর উদ্ভাবনই বিশ্বকে চালিত করবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, নবীকরণযোগ্য শক্তি, মহাকাশ গবেষণা, জৈবপ্রযুক্তি ও কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ক্ষেত্রবিশ্বে চাকরির সুযোগ তৈরি করবে। ভারতের জাতীয় শিক্ষা নীতি ইতিমধ্যে শিক্ষার প্রতিটি স্তরে STEM বিষয়গুলোর অন্তর্ভুক্তির ওপর জোর দিয়েছে। তবু বিজ্ঞানপড়ুয়া ছাত্রছাত্রী কমতে থাকলে অসম পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকিতে থাকবে।
মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের একটি দৃশ্য
ভবিষ্যতের এআই বিশ্লেষক, পরিবেশ বিজ্ঞানী, চিকিৎসা গবেষক বা মহাকাশ প্রকৌশলীদের জন্য বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার দৃঢ় ভিত্তি অপরিহার্য। তাই এখন কেবল পতন রোধ করাই নয়, বরং কৌতূহল ও অনুসন্ধানী মানসিকতার সংস্কৃতি পুনর্জীবিত করাও জরুরি। এর জন্য প্রয়োজন বহুমুখী পদক্ষেপ। অসম বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও পরিবেশ পরিষদ (ASTEC) এই পুনরুজ্জীবনে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারে। রাজ্যজুড়ে থাকা ২১৯টি আর্যভট্ট বিজ্ঞান কেন্দ্রের মাধ্যমে ASTEC ইতিমধ্যেই স্থানীয় বৈজ্ঞানিক সম্পৃক্ততার পরিকাঠামো তৈরি করেছে। এই কেন্দ্রগুলো দুরূহ অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলির জন্য ভার্চুয়াল ল্যাব, মোবাইল বিজ্ঞান ইউনিট এবং সৌরশক্তিচালিত ল্যাব সরঞ্জাম প্রদান করে ব্যবহারিক শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।
অসম বিজ্ঞান সমিতির ভূমিকাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। রাজ্যের প্রাচীনতম বৈজ্ঞানিক সংগঠনটি বিদ্যালয়, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমাজের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করতে পারে। আন্তঃবিদ্যালয় বিজ্ঞান উৎসব, প্রদর্শনী এবং মেন্টরশিপ কর্মসূচির আয়োজনের মাধ্যমে অভিজ্ঞ বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের দুর্বল শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে যুক্ত করা সম্ভব। এতে বৈজ্ঞানিক সাক্ষরতা যেমন বাড়বে, তেমনি বিজ্ঞানকে ‘কঠিন বিষয়’ হিসেবে দেখার ধারণাও বদলাবে।
সরকারকেও কেবল নীতিনির্ধারণ নয়, বরং ল্যাবগুলো সঠিকভাবে সজ্জিত করা, শিক্ষকদের অনুপ্রাণিত করা এবং পাঠ্যক্রমকে অনুসন্ধানভিত্তিক শিক্ষার দিকে পুনর্নির্দেশিত করার দায়িত্ব নিতে হবে। শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে 5E মডেল- এংগেজ, এক্সপ্লোর, এক্সপ্লেইন, এলাবরেট, ইভালুয়েট; এর মতো আধুনিক শিক্ষাবিজ্ঞান পদ্ধতির ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন, যা শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনাকে উৎসাহিত করে।
আর্যভট্ট বিজ্ঞান কেন্দ্র আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী কেশব মহন্ত
শিক্ষকদের উদ্ভাবনী পাঠদান, দক্ষতা-ভিত্তিক স্বীকৃতি এবং ডিজিটাল শিক্ষণ-উপকরণের ব্যবহারে প্রণোদনা প্রদান ক্লাসরুমের পরিবেশ বদলে দিতে পারে। বেসরকারি সংগঠন (NGO) ও শিক্ষামূলক ট্রাস্টগুলো এই পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হতে পারে। তাঁরা তাঁদের উদ্ভাবনী উদ্যোগ ও সমাজের সম্পৃক্ততার মাধ্যমে দেখাতে পারেন, কীভাবে মেন্টরশিপ ও জনসম্পৃক্ততা বিজ্ঞানচর্চাকে মানুষের জীবনের অংশ করে তুলতে পারে।
স্বেচ্ছাসেবক, স্থানীয় শিক্ষাবিদ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে এনজিওগুলো মোবাইল বিজ্ঞান গবেষণাগার পরিচালনা, গ্রামীণ বিজ্ঞান মেলা আয়োজন এবং তরুণ উদ্ভাবকদের প্রশিক্ষণ দিতে পারে। তারা ASTEC, ইলোরা বিজ্ঞান মঞ্চ এবং অসম বিজ্ঞান সমিতির সঙ্গে সহযোগিতা করে নিশ্চিত করতে পারে যে গ্রামীণ বিদ্যালয়গুলো ডিজিটাল বিপ্লব থেকে পিছিয়ে না পড়ে।
বিশেষত, গ্রামীণ ও বন্যাপীড়িত জেলাগুলিতে ডিজিটাল বিভাজন ভয়ঙ্কর বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে অফলাইন-প্রথম ডিজিটাল ক্লাসরুম, অসমীয়া ও জনজাতীয় ভাষায় প্রি-লোডেড ট্যাবলেট এবং কমিউনিটি লার্নিং সেন্টারের মতো উদ্ভাবনী সমাধান সীমিত সংযোগযুক্ত এলাকাতেও মানসম্মত বিজ্ঞান শিক্ষা পৌঁছে দিতে পারে। এই কেন্দ্রগুলো পরিবেশ সচেতনতা এবং নাগরিকবিজ্ঞান প্রকল্পের কেন্দ্র হিসেবেও কাজ করতে পারে, যাতে বিজ্ঞান কেবল পাঠ্যপুস্তকের বিষয় না হয়ে জীবনের অঙ্গ হয়ে ওঠে। প্রধানমন্ত্রীর ২০২৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর বিএসএনএলের ৪জি নেটওয়ার্ক উদ্বোধন ও দুর্গম অঞ্চলে ৯৭,৫০০টি মোবাইল টাওয়ার চালু করার কর্মসূচি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে তা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পারে।
বিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিতে শিক্ষিকার সঙ্গে শিক্ষার্থীরা
অবশেষে, বিজ্ঞানচর্চা জাগিয়ে তুলতে কাঠামোগত ও পাঠ্যক্রম পরিবর্তনের পাশাপাশি প্রয়োজন সাংস্কৃতিক পরিবর্তনেরও। সমাজকে খেলাধুলা বা বিনোদনের মতো বৈজ্ঞানিক অর্জনকেও উদযাপন করতে হবে। অভিভাবকদের জানানো উচিত যে বিজ্ঞান পড়া মানে কেবল চিকিৎসক বা প্রকৌশলী হওয়া নয়, এতে আরও বহু কর্মজগতের সুযোগ উন্মুক্ত হয়।
গণমাধ্যমে প্রচার অভিযান, জনপ্রিয় বিজ্ঞান অনুষ্ঠান এবং স্থানীয় ভাষায় জনসচেতন বক্তৃতা বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ পুনরায় জাগিয়ে তুলতে পারে। অসম যদি ভবিষ্যতের জন্য এমন একটি কর্মশক্তি গঠন করতে চায়, যা তথ্য-নির্ভর ও এআই-চালিত বিশ্বকে পরিচালনা করতে সক্ষম, তবে আজ থেকেই তরুণদের মধ্যে বিজ্ঞানচিন্তার কৌতূহল সৃষ্টি করতে হবে। প্রতিটি বিদ্যালয় হতে হবে চিন্তার ক্ষুদ্র পরীক্ষাগার, প্রতিটি শিক্ষক হতে হবে অনুপ্রেরণাদাতা, প্রতিটি এনজিও হবে সহায়ক এবং প্রতিটি নীতিনির্ধারক হবে কৌতূহলের রক্ষক। ASTEC, অসম বিজ্ঞান সমিতি এবং নাগরিক সংগঠনগুলির যৌথ উদ্যোগেই ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় শিক্ষার এক নতুন জাগরণ সম্ভব।
বিজ্ঞান সর্বদা প্রকৃতি, সমাজ ও নিজের সম্পর্কে প্রশ্ন তোলে। এখন আসামের সামনে সেই প্রশ্ন, আমরা কি নিশ্চিত করতে পারব যে পরবর্তী প্রজন্ম কেবল আমাদের নদী-অরণ্যের উত্তরাধিকারীই নয়, বরং অনুসন্ধানের মানসিকতারও উত্তরাধিকারী হবে? উত্তর একটাই- সরকার ও জনগণের সম্মিলিত উদ্যোগে বিজ্ঞান শিক্ষা ব্যবস্থাকে এমনভাবে পুনর্গঠন করা, যা প্রতিটি শিশুকে ব্যর্থতার ভয় নয়, বোঝার বিস্ময়ে অনুপ্রাণিত করে নক্ষত্রের দিকে তাকাতে শেখাবে। কেবল এই ধরনের সম্মিলিত জাগরণই অসমকে ভারতের বৈজ্ঞানিক অভিযাত্রায় তার প্রাপ্য স্থান ফিরিয়ে দিতে পারে এবং অনুসন্ধানের আগ্রহ কখনও ম্লান হতে দেবে না।
(লেখক অসম সরকারের অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ মহাপরিচালক; অসম লোকসেবা কমিশনের প্রাক্তন সভাপতি এবং ‘আওয়াজ–দ্যা ভয়েস অসম’-এর মুখ্য কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা)