রাজীব দত্ত / শিবসাগর
সুধাকণ্ঠ ড. ভূপেন হাজরিকাকে যদি আমরা সংগীতের কিংবদন্তী বলে অভিহিত করি, তাহলে বিশিষ্ট সাহিত্যিক ইমরান শাহ তাঁর লেখনীর মাধ্যমে বহু বিস্ময়কর সৃষ্টি করার জন্য পরিচিত। নম্র ও লাজুক স্বভাবের কিংবদন্তী সাহিত্যিক ইমরান শাহ তাঁর হাস্যোজ্জ্বল চরিত্রের মাধ্যমে যে কোনো ব্যক্তির মন জয় করতে পারেন। এই সরল ব্যক্তিত্বের কারণে তিনি সকলের কাছ থেকে প্রাপ্য সম্মান লাভ করেন।ভারত সরকার ২০২১ সালে চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান পদ্মশ্রীতে সম্মানিত নবাব ইমরান শাহ সত্যিই অসমীয়া সাহিত্যের অপরাজেয় সম্রাট (নবাব)। শব্দের জাদুকর, কবি, গীতিকার, সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, পণ্ডিত এবং শিক্ষাবিদ হিসেবে তিনি অসমীয়া সাহিত্যকে বহু মূল্যবান রচনা-সম্ভারে সমৃদ্ধ করেছেন ।
মাঝে মাঝে ঈশান দত্ত, অনামিকা বরুয়া, কুম্ভকর্ণ এবং অনিমেশ বরুয়া ছদ্মনামে লেখালেখি করা খ্যাতনামা সাহিত্যিক আজ পর্যন্ত অসম সরকারের মেগর এডুকেশন ট্রাস্ট, আজান পীর পুরস্কার (২০০৮), অসম উপত্যকা সাহিত্য পুরস্কার (২০২২), সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুৱা পুরস্কার (২০২২), শব্দ সাহিত্য পুরস্কার, সৈয়দ আবদুল মালিক পুরস্কার (২০১৩), রংপুর গৌরব পুরস্কার (২০১৬), বড় অসম সমন্বয় পুরস্কার (২০২১) সহ বহু সম্মানে ভূষিত হয়েছেন।
পদ্মশ্রী ইমরান শাহ
‘আওয়াজ দ্য ভয়েস’-এর তরফে, পূর্ব অসমের শিবসাগর শহরের ধাই আলিতে ইমরান শাহের বাসভবনে তাঁর সঙ্গে এক কথোপকথনে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করা হয়। তাঁর সঙ্গে হওয়া আলাপচারিতার কিছু অংশ নিচে দেওয়া হলো
আওয়াজ দ্য ভয়েস: শুরুতেই বলুন তো, কলম ও কাগজ তুলে নেওয়ার অনুপ্রেরণা কোথায় পেলেন?
ইমরান শাহ: সবকিছু শুরু হয়েছিল আমার স্কুলজীবনে (শিবসাগর গভর্নমেন্ট হাই স্কুল এবং এমপি স্কুল), যখন আমি বন্ধু-বান্ধবীদের জন্য কবিতা লিখতাম। সেই সময় আমি তাদের জন্য কয়েকটি ছোট কবিতা লিখেছিলাম। যদিও তখন আমি কবিতার প্রতি খুব গুরুত্ব দিয়ে আকৃষ্ট হইনি। আত্মবিশ্বাস অর্জনের পর, নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় আমার প্রথম কবিতার সংকলন ‘বনবাসী’ (১৯৫১) প্রকাশিত হয় (আমার সহপাঠী লিয়াকত হুসেইন ছিলেন প্রকাশক)। দশম শ্রেণিতে বন্ধু-বান্ধবীদের উৎসাহে আমি আমার প্রথম উপন্যাস ‘সংগীতর সিপারে’ (১৯৫২) লিখেছিলাম।
কলেজজীবন শুরু হওয়ার পর আমি গুরুত্ব সহকারে লেখালেখি শুরু করি। আমার একটি ছোটগল্প ১৯৫৭-৫৮ সালে তৎকালীন প্রভাবশালী অসমিয়া সাহিত্য পত্রিকা ‘রামধেনু’-তে প্রকাশিত হয়েছিল। তারপর থেকে আমি একটানা লিখে চলেছি। আমি যা ভালোবাসি, সেটাই লিখেছি—আর তার বিনিময়ে মানুষ আমাকে অনেক ভালোবাসা দিয়েছে।
আওয়াজ দ্য ভয়েস: আপনার লেখা কোনটি আপনার সবচেয়ে প্রিয় সৃষ্টি? কেন এটি প্রিয়?
ইমরান শাহ: এই বিষয়ে আমার কোনও নির্দিষ্ট উত্তর নেই, কারণ আমি আমার সব রচনাকেই ভালোবাসি। যদি কেউ জিজ্ঞেস করে কোনটি আমার প্রিয় সৃষ্টি, আমি বলব—আমি যেসব ছোটগল্প, উপন্যাস ও কবিতা রচনা করেছি, সবই আমার প্রিয়। আমি সমসাময়িক মনোবিজ্ঞানের ভিত্তিতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখে যাই। কোনটি সবচেয়ে প্রিয়—এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর আমার পক্ষে দেওয়া কঠিন।
আওয়াজ দ্য ভয়েস: কোন সৃষ্টি নিয়ে আপনাকে সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করতে হয়েছিল? এবং কেন?
ইমরান শাহ: আমার প্রতিটি রচনার জন্য সমান পরিশ্রম করতে হয়েছে। লেখার ক্ষেত্রে আমি কখনো কষ্ট অনুভব করিনি। যখনই নিজেকে মুক্ত মনে করি, তখনই কাগজ-কলম হাতে নিই। যখনই মনে হয়, হাতে যথেষ্ট উপাদান আছে, তখনই লিখতে বসি।

পদ্মশ্রী ইমরান শাহকে সংবর্ধনা
আওয়াজ দ্য ভয়েস: আপনি কি মনে করেন, সময়মতো স্বীকৃতি পেয়েছেন? না কি স্বীকৃতি পেতে দেরি হয়েছে?
ইমরান শাহ: আমি তেমনভাবে চিন্তা করি না। আমি কখনোই পুরস্কার বা স্বীকৃতির জন্য লিখিনি। আমার সাহিত্যিক অবদানের ভিত্তিতে মানুষ আমাকে পুরস্কৃত করেছে। আমাকে মূল্যায়ন করার অধিকার শুধুমাত্র পাঠকেরই আছে।
আওয়াজ দ্য ভয়েস: কোনো স্বীকৃতি না পাওয়ায় নিজেকে অবহেলিত মনে করেছেন কখনো?
ইমরান শাহ: আবারও বলব, আমি এভাবে চিন্তা করি না, কারণ আমি কখনোই পুরস্কার বা স্বীকৃতির জন্য ছুটে বেড়াইনি। আগেভাগে হোক বা দেরিতে,কে স্বীকৃতি পাবে তা নিয়ে আমি উদাসীন।
আওয়াজ দ্য ভয়েস: একটি ছোট সম্প্রদায় (অসমীয়া মুসলমান) থেকে উঠে এসে অসম সাহিত্য জগতে আপনার উপস্থিতি ও অবদান সম্পর্কে আপনি কীভাবে অনুভব করেন?
ইমরান শাহ: প্রশ্নটি আমাকে কষ্ট দিয়েছে। আমি সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগরিষ্ঠ—কোনোটাই নই। আমি মনেপ্রাণে একজন অসমীয়া। শুধুমাত্র নামের কারণে আমাকে কেন এইভাবে আলাদা করে দেখা হবে? ধর্ম আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস। সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগরিষ্ঠর এই বিভাজন থেকে আমি সবসময় দূরে থাকি। এ ধরনের বিভাজন সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বর্তমানে এগুলো আমাদের পাঠ্যবইয়েও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা অসমীয়া সমাজের জন্য এক অপূরণীয় অন্যায়। এই প্রশ্নের যেকোনো উত্তর সমাজকে ভুল পথে চালিত করতে পারে।
আওয়াজ দ্য ভয়েস: অসম সাহিত্য সভার সভাপতির পদে আপনার নাম যখন আলোচিত হয়েছিল, তখন কি আপনি কোনও প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছিলেন?
ইমরান শাহ: অসম সাহিত্য সভার সভাপতি হওয়ার ক্ষেত্রে আমার কোনও সমস্যা হয়নি। কেউ একজন আমার নাম প্রস্তাব করেছিলেন। তার আগ পর্যন্ত আমি একজন ঘরকুনো ব্যক্তি ছিলাম, প্রচার বা লবি করিনি। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে আমি সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলাম, যা নিঃসন্দেহে আমার সাহিত্যকর্মের জন্য এক বড় স্বীকৃতি।
আওয়াজ দ্য ভয়েস: সমসাময়িক ভারতীয় সাহিত্য সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
ইমরান শাহ: এটি অত্যন্ত উজ্জ্বল। কিন্তু অসমীয়া সাহিত্য প্রকাশকের অভাবে পিছিয়ে আছে। কোনো প্রকাশক এগিয়ে আসে না, লেখকরাই নিজেরা প্রকাশ করছেন। অথচ অসমে বহু কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বুঝি না কেন এসব প্রতিষ্ঠান বই প্রকাশে এগিয়ে আসে না? আমার একটি গল্প ‘এটুকু দুখ’ হিন্দিতে অনুবাদ করেছিলেন বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন অধ্যাপক ডঃ শারবেই। তিন মাস পর গল্পটি ইংরেজিতে ‘A Piece of Sadness’ নামে অনূদিত হয়। এরপর এটি বাংলা, তেলেগু, তামিল, মালয়ালমসহ অনেক ভাষায় অনূদিত হয়। এছাড়াও, আমার গল্প ‘মরম’, ‘যুদ্ধ’ এবং অন্যান্য নির্বাচিত গল্প বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। আমার, সৈয়দ আবদুল মালিক এবং সৌরভ চলিহার রচনাগুলি যদি ভারতীয় অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ হয়, তাহলে অসমীয়া ভাষা যে কতটা উপকৃত হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়।
আওয়াজ দ্য ভয়েস: সমসাময়িক ভারতীয় সাহিত্যের প্রেক্ষাপটে আপনি মনে করেন অসমীয়া সাহিত্য কোথায় অবস্থান করছে?
ইমরান শাহ: নিঃসন্দেহে এক নম্বরে। আপনি জানেন, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার হলো ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার, এবং এটি ৩ জন অসমীয়া সাহিত্যিক পেয়েছেন—বীরেন্দ্র কুমার ভট্টাচার্য, ডঃ মামনি রয়সম গোস্বামী ও নীলমণি ফুকন। তাহলে আমরা হীনমন্যতায় কেন ভুগব? কেউ কি আমাদের সেই স্থানটি দখল করতে পারবে?
আওয়াজ দ্য ভয়েস: অসমীয়া সাহিত্যের উন্নতির জন্য আরও কী করা যেতে পারে?
ইমরান শাহ: আমাদের প্রকাশনা সংস্থাগুলো একেবারেই দুর্বল। সাহিত্য প্রকাশের জন্য কোনও সক্রিয় প্রকাশক নেই, সবাই কেবল ব্যবসা করছে। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব প্রকাশনা বিভাগ থাকে। আমাদের দেশে তা অনুপস্থিত। এমনকি ব্রিটিশ আমলেও, অসম সরকারের শিক্ষা বিভাগ থেকে অসমের প্রথম পিএইচডি ডিগ্রি-ধারী ডঃ মইদুল ইসলাম বরার গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। উন্নত দেশগুলোতে সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতার একটি শক্তিশালী সংস্কৃতি আছে। সাহিত্য বিকাশের জন্য আমাদের সেই সংস্কৃতি অনুসরণ করা উচিত।
আওয়াজ দ্য ভয়েস: যদিও অসমের মোট জনসংখ্যার ৩৪%-এর বেশি মুসলমান, তথাপি অসমীয়া মুসলমান সমাজ এখনো সংখ্যার বিচারে একটি নগণ্য সংখ্যালঘু। বর্তমান অসম সরকার পাঁচটি উপগোষ্ঠীর অসমীয়া মুসলমানকে ভুমিপুত্রর স্বীকৃতি দিয়েছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী? এই সম্প্রদায়ের বিকাশের জন্য সরকার কীভাবে এগিয়ে আসা উচিত বলে আপনি মনে করেন?
ইমরান শাহ: আমি এই বিষয়টি অন্যভাবে দেখি। যারা এইসব বিষয় নিয়ে চিন্তিত, তারা যেন এর সমাধানের পথও দেখান। আমি এ ধরণের বিতর্কে অংশ নিই না, এবং নিজেকে কখনো সংখ্যালঘু, সংখ্যাগরিষ্ঠ বা খিলঞ্জীয়া বলে দাবি করি না। আমার পূর্বপুরুষেরা অসমীয়া হিসেবে এই ভূমিতে জীবন অতিবাহিত করেছেন, আমিও নিজেকে আন্তরিকভাবে একজন অসমীয়া বলেই অনুভব করি। সরকারকে সংখ্যালঘুদের জন্য আলাদা কিছু করার দরকার নেই। তাদের উচিত সমস্ত সম্প্রদায়ের সার্বিক উন্নয়নের জন্য কাজ করা। তবেই সকলের প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব হবে।