রোজী রহমান এক ব্যতিক্রমী মডেল, সমাজসেবিকা ও রাজনীতিবিদ

Story by  Munni Begum | Posted by  Sudip sharma chowdhury • 1 d ago
রোজী রহমান
রোজী রহমান
মুন্নী বেগম,গুয়াহাটিঃ 

ফ্যাশন জগতকে কেন্দ্র করে আমাদের সাধারণ মানুষের মনে নানা ধরনের নেতিবাচক প্রশ্নের উদ্ভব হয়। অনেকেই এই জগতটিকে ছোট পোশাক পরা ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে গ্রহণ করার এক মাধ্যম বলে মনে করেন। কিন্তু ফ্যাশন বা মডেলিং মানেই শুধু ছোট পোশাক পরে র‍্যাম্পে হাঁটা নয়। মার্জিত ও শালীন পোশাক পরেও ফ্যাশনের জগতে প্রভাব ফেলা যায়—এই কথাটি প্রমাণ করে দেখিয়েছেন আসামের জনপ্রিয় মডেল রোজী রহমান।

রাজনীতি ও সমাজসেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত থেকেও তিনি ফ্যাশন জগতে এক স্বতন্ত্র স্থান দখল করতে সক্ষম হয়েছেন।গুয়াহাটি মহানগরের বাসিন্দা মডেল রোজী রহমান 'আওয়াজ - দ্যা ভয়েস' এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন,“ফ্যাশনের জগত নিয়ে আমার আগে খুব একটা আগ্রহ ছিল না, যদিও নিজে সাজতে আমি বরাবরই খুব পছন্দ করতাম। আমি কখনো ভাবিনি যে নিজেকে একজন মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব। ছোটবেলা থেকেই আমি নাচ-গানের সঙ্গে জড়িত ছিলাম।
 

মডেল রোজী রহমান
 
লকডাউনের সময়, অর্থাৎ ২০২১ সালে, আমার বান্ধবী ঋতু গগৈ ও হেমলতা চেতিয়াই আমাকে একটি ম্যাগাজিনের জন্য মডেলিং করতে জোর দিয়েছিল। তখন আমি অসমিয়া ম্যাগাজিন ‘বেতুপাট’-এর জন্য মডেল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করি। শুরুতে আমি ‘নন্দিনী’ ও ‘সখী’ ম্যাগাজিনে মডেলিংয়ের কাজ শুরু করি। পরে সাঈদা শিফা ফিরদৌসিয়ার ‘চেঞ্জিং সিজন’ নামক বুটিক থেকে মেখলা-চাদরের একটি ফ্যাশন শো-এর অফার পাই। তারপরে আবার ড. নম্রতা শর্মার কাছ থেকেও একটি শো-এর জন্য অফার পাই। এভাবে একটার পর একটা কাজ পেয়ে আমি ধীরে ধীরে মডেলিংয়ের জগতে প্রবেশ করি।” 

উল্লেখযোগ্য, অসমীয়া ঐতিহ্যবাহী মেখেলা-চাদরের পাশাপাশি বিভিন্ন মার্জিত সাজ-পোশাক পরিধান করেও রোজী রহমান রাজ্যের গণ্ডি পেরিয়ে জাতীয় স্তরের সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় একাধিক মুকুট জয় করতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর মতে, মার্জিত ও শালীন পোশাক পরেও ফ্যাশনের জগতে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়।

রোজী রহমান বলেন,“আমি যেহেতু ‘মিস’ পর্যায়ের পরিবর্তে ‘মিসেস’ পর্যায়ের সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছি, তাই আমি মনে করি মার্জিত পোশাক পরেও ফ্যাশন জগতে সফল হওয়া সম্ভব। কারণ, আমি সবসময় গাউন বা মেখেলা-চাদর ইত্যাদি শালীন পোশাক পরেই র‍্যাম্পে হেঁটেছি এবং বিজয়ীও হয়েছি।”

কর্মে বিশ্বাসী রোজী রহমান ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে নিম্নলিখিত ১১টি খেতাব জয় করেছেন—২০২১: Most Beautiful Model of the Year,২০২১: Red Carpet Beautiful Queen World – 1st Runner-up,২০২২: International Global Universe,২০২২: Mrs. India International Chhattisgar্‌২০২৩: Mrs. International Ambassador,২০২৩: Mrs. Global Delhi,২০২৩: Mrs. Royal Haryana,২০২৩: Mrs Star Univers্‌২০২৩: Mrs Award, Delhi,২০২৩: Bharat Gaurav Award,২০২৩: Mrs. Popular Face of India,২০২৩: Most Prestigious Model of the Year
 

রোজী রহমান মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত
 
এই সমস্ত অর্জনেই তিনি প্রমাণ করেছেন যে, সংস্কৃতি, শালীনতা, ও আত্মবিশ্বাসকে একত্রিত করেও আন্তর্জাতিক মঞ্চে সফলতা অর্জন করা সম্ভব। 
 
মডেল রোজী রহমান বলেন,“আমি বিশ্বাস করি, সহায়তা ছাড়া কোনো কাজেই মনোযোগ দিয়ে সফল হওয়া সম্ভব নয়। যে কোনো কাজে সফলতা পেতে কষ্টের পাশাপাশি পাশে থেকে সমর্থন জোগানোরও প্রয়োজন রয়েছে। কারণ, আমাদের মুসলিম সমাজে এখনো এমন একটি ভুল ধারণা প্রচলিত আছে যে, মহিলাদের সবসময় পর্দার আড়ালেই থাকতে হবে। সেই অবস্থায় ফ্যাশন দুনিয়ায় কাজ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া নিঃসন্দেহে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে আমার সৌভাগ্য যে, আমি পরিবার কিংবা সমাজের কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হইনি। বরং, আমার স্বামী আমাকে সবসময় উৎসাহ দিয়ে এসেছে এবং বন্ধুরাও সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেছে। তাই আজ আমি সাফল্যের শিখরে পৌঁছাতে পেরেছি।”

ফ্যাশনের পাশাপাশি রোজী রহমান রাজনৈতিক ও সমাজসেবামূলক কাজের সঙ্গেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত রয়েছেন। বর্তমানে তিনি মহিলা রাষ্ট্র সুরক্ষা সংগঠন অব ইন্ডিয়া-র আসামের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন। তাছাড়াও তিনি বিহু সুরক্ষা মঞ্চ অসম, সাংস্কৃতিক মহাসভা অসম, রংঢালী সাংস্কৃতিক সংস্থা, ও সাতসরী সাংস্কৃতিক সংস্থা সহ একাধিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত।

তিনি বলেন,“এই সময়ে অসমের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি অনেক দূর এগিয়ে গেছে। কারণ, অসমীয়া সংস্কৃতিতে বাহারি এবং আকর্ষণীয় সাজপোশাকের এক বিপুল সম্ভার রয়েছে। দেশ বা বিদেশ, যেখানেই হোক না কেন, আমাদের ঐতিহ্যবাহী মেখেলা-চাদরের একটি স্বতন্ত্র মর্যাদা আছে। পাট, মূগা,  এড়ি প্রভৃতি থেকে শুধু মেখেলা-চাদরই নয়, এখন নানা ধরণের ফ্যাশনেবল পোশাকও তৈরি হচ্ছে। এই উদ্যোগে যুক্ত হয়ে অনেকেই আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠেছেন এবং বিদেশেও গিয়ে আসামের নাম উজ্জ্বল করছেন। তাই আমি মনে করি, এখন ফ্যাশনকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করা সম্ভব।”

ছেহেলি কল্যাণ সমিতি-র প্রতিষ্ঠাতা রোজী রহমান শিশু ও মহিলাদের ক্ষমতায়নের পাশাপাশি, আসামের হারিয়ে যাওয়া স্থানীয় খেলাধুলা এবং লোক সংস্কৃতিকে নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার জন্যও কাজ করে চলেছেন।এছাড়াও,তিনি দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী বহু শিশুকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে শিক্ষাদান করে মানবতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।

এই প্রসঙ্গে রোজী বলেন,"আমি মনে করি, প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী সমাজের জন্য কিছু না কিছু কাজ করে যাওয়া। সেই চিন্তাভাবনা থেকেই আমি আমার দায়িত্ব বলে মনে করে ২০১২ সাল থেকে আমার নিজের সন্তানের পাশাপাশি বহু দরিদ্র শিশুদের সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পড়িয়ে আসছি।"

তিনি আরও জানান,"সেহেলি কল্যাণ সমিতির মাধ্যমে আমি গরিব মানুষদের ভালো জামাকাপড়, স্কুল ইউনিফর্ম, জুতো ইত্যাদি দান করে আসছি। অন্যদিকে ‘আশার রেঙনি’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী গোষ্ঠীর মাধ্যমে অসমের বিভিন্ন অঞ্চলের বন্যা–পীড়িত মানুষদের সহায়তা করে চলেছি।
 
এছাড়াও, গুয়াহাটির ‘সাদরি কন্যা’ নামক একটি অনাথ শিশু বিদ্যালয়ে সুযোগ পেলেই গিয়ে আমি বিনামূল্যে পাঠদান করে থাকি।”