দেবকিশোর চক্রবর্তী
রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর বিতর্কিত মন্তব্য ঘিরে উত্তাল হয়ে উঠেছে বঙ্গ রাজনীতি। সম্প্রতি এক জনসভায় তিনি বলেন, “কাঁটাতারের বেড়া টপকে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করা হিন্দু, মুসলমান, যে ধর্মেরই হোক না কেন, সকলকেই ফিরে যেতে হবে। রাজ্যে অবৈধ অনুপ্রবেশ আর বরদাস্ত করা হবে না।” তাঁর এই মন্তব্য প্রকাশ্যে আসার পরই রাজনৈতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। শাসক দল যেখানে এই মন্তব্যকে “বিভাজনমূলক” ও “রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত” বলে দাবি করেছে, সেখানে বিরোধী শিবিরের ভেতরেও তৈরি হয়েছে অস্বস্তির সুর।
বিশেষ করে বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি এবং বর্তমান কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার শুভেন্দুর মন্তব্য থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছেন। সংবাদমাধ্যমের প্রশ্নের উত্তরে তিনি স্পষ্ট জানান, “শুভেন্দুর ওই বক্তব্যে আমার সায় নেই। অবৈধ অনুপ্রবেশ অবশ্যই রোধ করতে হবে, কিন্তু মন্তব্যটি যেভাবে বলা হয়েছে, তাতে বিভ্রান্তির সম্ভাবনা থাকে।” তাঁর এই প্রতিক্রিয়া বিজেপির ভিতরেই মতভেদের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।
শুভেন্দু অধিকারী এবং সুকান্ত মজুমদার
শুভেন্দুর মন্তব্যকে হাতিয়ার করে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা তীব্র আক্রমণ শানিয়েছেন। শাসক শিবিরের বক্তব্য, বিরোধী দলনেতার মন্তব্যে রাজ্যের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে আঘাত করার চেষ্টা রয়েছে। তৃণমূলের দাবি, বিজেপি দীর্ঘদিন ধরে “অনুপ্রবেশ” ইস্যুকে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগাচ্ছে। শাসক দলের এক মুখপাত্র বলেন, “বেড়া টপকে আসা মানুষ বলতে শুভেন্দু অধিকারী কাদের বোঝাচ্ছেন? তাঁর মন্তব্যে বিভাজন ও আতঙ্ক ছড়ানোর স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে। বাংলার মাটি এ ধরনের রাজনীতি মানে না।”
অন্যদিকে বিজেপির একটি অংশ মনে করছে, শুভেন্দুর বক্তব্য মূলত অবৈধ অনুপ্রবেশ নিয়ে দলের কেন্দ্রীয় নীতিকেই প্রতিফলিত করে। তাঁদের যুক্তি, অনুপ্রবেশ রোধ করা সরকারের কাজ, এবং এ বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেওয়া হলে তা আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সাহায্য করে। তবে বক্তব্যের ভাষা ও প্রকাশভঙ্গি বিতর্কের জন্ম দিতে পারে, এ কথা অস্বীকার করছে না বিজেপির একাংশও।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, লোকসভা নির্বাচন ও ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোটের আগে “অনুপ্রবেশ” ইস্যুটি যে আবারও কেন্দ্রে উঠে আসবে, শুভেন্দুর মন্তব্য সেই ইঙ্গিতই বহন করছে। বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ, বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বের মধ্যে যেভাবে বারবার মতভেদের চিত্র প্রকাশ্যে আসছে, তা দলের ভোট-রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে।
এদিকে সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই মন্তব্য নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। সীমান্তসংলগ্ন এলাকার বাসিন্দাদের একটি অংশ অবৈধ অনুপ্রবেশ রোধের পক্ষে মত দিলেও অনেকেই মনে করছেন, ধর্ম নির্বিশেষে সকলকে “ফিরিয়ে দেওয়ার” মতো বক্তব্য পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করতে পারে। মানবাধিকার সংগঠনগুলির একাংশ ইতিমধ্যেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাঁদের বক্তব্য, যেসব মানুষেরা জীবন বাঁচাতে বা চরম আর্থিক সঙ্কটের কারণে সীমান্ত পেরিয়ে আসে, তাদের শুধু “অনুপ্রবেশকারী” হিসেবে দেখলে সমস্যা সমাধান হবে না; প্রয়োজন উন্নত নীতি ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি।
শুভেন্দু অধিকারী
শুভেন্দু অধিকারী এখনও পর্যন্ত নিজের মন্তব্য থেকে সরেননি। তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল জানিয়েছে, তিনি রাজনৈতিকভাবে ইস্যুটি আরো জোরালোভাবে তুলতে চান। অন্যদিকে সুকান্ত মজুমদারের সাম্প্রতিক প্রতিক্রিয়া বিজেপির ভেতরের কৌশলগত দ্বিধা ও নীরব টানাপোড়েন প্রকাশ্যে এনে ফেলেছে বলেই মত রাজনৈতিক মহলের।
রাজ্যের রাজনৈতিক আবহ তাই আবারও উত্তপ্ত। বিরোধী দলনেতার মন্তব্য থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর পাল্টা অবস্থান, সব মিলিয়ে রাজনীতির ময়দানে নয়া সমীকরণ তৈরি হচ্ছে কিনা, তা নিয়ে এখন জল্পনা তুঙ্গে। আগামী দিনে এই বিতর্ক আদৌ থিতু হয়, না কি আরও বড় রাজনৈতিক তরঙ্গ তোলে, সেদিকেই নজর রাখছে রাজ্যের সব পক্ষই।