সুদীপ শর্মা চৌধুরী
ভারতীয় সঙ্গীতের আকাশে এমন কিছু নক্ষত্র আছে, যাদের আলো সময়ের সীমা মানে না। মোহাম্মদ রফি তেমনই এক নাম, যার কণ্ঠে আবেগ, ভালোবাসা, বেদনা আর ভক্তির সুর একসঙ্গে মিশে গিয়েছিল। আজ তাঁর জন্মদিনে ফিরে দেখা যাক সেই সুরের মানুষের জীবনের গল্প।
১৯২৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর, অবিভক্ত পাঞ্জাবের কোটলা সুলতান সিং গ্রামে জন্ম নেন মোহাম্মদ রফি। ছোটবেলাতেই তাঁর কণ্ঠে লুকিয়ে থাকা ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভা সকলের নজর কেড়ে নেয়। গ্রামের মেলায় ফকিরের গান শুনে অনুকরণ করতেন ছোট্ট রফি, সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল এক অদ্ভুত সুরযাত্রা।
পরবর্তীতে মুম্বইয়ে এসে কঠোর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি। খুব দ্রুতই চলচ্চিত্র জগতে তাঁর কণ্ঠ হয়ে ওঠে নায়কের আবেগের ভাষা। প্রেমের গান হোক বা বিরহের আর্তি, ভক্তিগীতি হোক কিংবা দেশাত্মবোধক সঙ্গীত, সব ক্ষেত্রেই মোহাম্মদ রফির কণ্ঠ ছিল অতুলনীয়।
হিন্দির পাশাপাশি তিনি গেয়েছেন বাংলা, উর্দু, পাঞ্জাবি, তামিল, তেলুগু, মারাঠি, গুজরাটি, অসমীয়া, কন্নড়-সহ নানা ভারতীয় ভাষায় গান। ভাষার সীমা তাঁর কাছে কখনও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি; কারণ সুরই ছিল তাঁর আসল ভাষা।
এক বিস্ময়কর তথ্য আজও মানুষকে অবাক করে, মোহাম্মদ রফির গাওয়া “আই লাভ ইউ” কে ১০১টিরও বেশি ভাষায় তিনি অন্তর্ভূক্ত করে এক বিরল সৃষ্টি রেখে গেছেন। ভালোবাসার এই সরল বাক্য তাঁর কণ্ঠে পেয়েছিল বিশ্বজনীন রূপ, যা প্রমাণ করে, সংগীত সত্যিই আন্তর্জাতিক ভাষা।
ভারত সরকার তাঁর অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করে। কিন্তু পুরস্কারের বাইরেও মানুষের হৃদয়ে যে সম্মান তিনি পেয়েছেন, তা অমূল্য।
ব্যক্তিজীবনে মোহাম্মদ রফি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, ধর্মপ্রাণ ও মানবিক। খ্যাতির শীর্ষে থেকেও সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করতেন। সহশিল্পীদের প্রতি তাঁর সৌহার্দ্য ও সাহায্যের মানসিকতা আজও কিংবদন্তি।
১৯৮০ সালে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেও, তাঁর কণ্ঠ আজও বেঁচে আছে. রেডিওতে, স্মৃতিতে, আর প্রতিটি সুরপ্রেমীর হৃদয়ে। জন্মদিনে তাই শুধু একজন গায়ককে নয়, আমরা স্মরণ করি এক যুগপুরুষকে, যিনি প্রমাণ করেছিলেন, সুরের কোনো সীমান্ত নেই, ভাষার কোনো বাধা নেই, শুধু থাকে অনুভবের গভীরতা।