জাতীয় শিক্ষক সম্মান পেলেন ত্রিপুরার বিদিশা মজুমদার

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 2 d ago
 ত্রিপুরা থেকে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত শিক্ষিকা বিদিশা মজুমদার
ত্রিপুরা থেকে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত শিক্ষিকা বিদিশা মজুমদার
 
নূরুল হক / আগরতলা

"শিক্ষকতাকে শুধু পেশা মনে করলে হবে না। শিক্ষকতা করতে গেলে দায়িত্ব নিতে হবে। আনন্দ উপভোগ করতে হবে, এই পেশা থেকে প্রতিনিয়ত নিজেকেও শিখতে হবে। যারা এটাকে 'বারডেন' কিংবা একটি সাধারণ সরকারি চাকরি হিসেবে চাপ মনে করেন তারা এই পেশায় কোন কিছু অ্যাচিভ করতে পারবেন না। "আমি রোজ শিখি। আমি আমার ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে শিখি। পরিবেশ থেকে শিখি। এখনো মা-বাবার কাছ থেকে শিখি। আমি মনে করি আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে শেখার একটা সুপ্ত ইচ্ছা রয়েছে। সেই ইচ্ছাটাকে ডি-মটিভেট করলে হবে না। শেখার আগ্রহকে সব সময় ধরে রাখতে হবে।"
 
ফোনের ওপার থেকে এই কথাগুলি বলছিলেন এ বছর শিক্ষক দিবসে ত্রিপুরা থেকে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত শিক্ষিকা বিদিশা মজুমদার। ৩৯ বছর বয়সী বিদিশা মজুমদার ত্রিপুরা সরকারের শিক্ষা দপ্তরের অধীনে একজন স্নাতকোত্তর শিক্ষিকা হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তিনি বর্তমানে ত্রিপুরার গোমতী জেলার হারিআনন্দ ইংলিশ মিডিয়াম হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের শিক্ষিকা। শিক্ষিকা বিদিশা মজুমদার ভারত সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ স্কুল এডুকেশন অ্যান্ড লিটারেসি বিভাগ কর্তৃক, অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ জাতীয় শিক্ষক পুরস্কার ২০২৫-এর জন্য নির্বাচিত হ‌য়েছেন। ৫ সেপ্টেম্বর শুক্রবার দিল্লিতে আয়োজিত (রাষ্ট্রপতি ভবনে) জাতীয় শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠানে শিক্ষিকা বিদিশা মজুমদারের হাতে জাতীয় পুরস্কার তুলে দেবেন দেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি।
 
ইতিমধ্যেই বিদিশা মজুমদার দিল্লিতে পৌঁছে গেছেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দেশের অন্যান্য বরেণ্য শিক্ষিক শিক্ষিকাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে শিক্ষক দিবস উপলক্ষে আয়োজিত মত বিনিময় সভায় তিনি অংশগ্রহণ করবেন। এই ব্যস্ততার ফাঁকেই বৃহস্পতিবার 'ফোন ইন' সাক্ষাৎকারে "আওয়াজ বাংলা" প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলেন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত শিক্ষিকা বিদিশা মজুমদার। তিনি নিজের পরিবার, শিক্ষা জীবন, কর্মজীবন, সাফল্য এবং সাফল্য অর্জন করতে গিয়ে বিভিন্ন প্রতিকূলতার কথা তুলে ধরেন।
 
বিদিশা মজুমদারের বলেন ছোট থেকেই তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন শিক্ষক হওয়ার। বাবা বিমল চন্দ্র মজুমদার ছিলেন একজন আদর্শবান শিক্ষক। পাশাপাশি তার দাদু এবং দিদার শিক্ষার প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল। তারা তৎকালীন সময়ে সমাজকে শিক্ষিত করতে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পারিবারিক আদর্শই তাকে শিক্ষা এবং শিক্ষকতার প্রতি বিশেষভাবে আকর্ষিত করেছিলাম। গ্রামের স্কুলে স্কুল স্তরের পড়াশোনা শেষ করে তিনি কল্যাণী ইউনিভার্সিটি থেকে কেমিস্ট্রিতে (রসায়ন) অনার্স নিয়ে স্নাতক ডিগ্রী করেন । পরবর্তীকালে ত্রিপুরা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১০ সালে কেমিস্ট্রিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নেন। একইসাথে তিনি কত্থক নৃত্য এবং নজরুল সংগীতের উপর বিশারদ করেন।
 
শিক্ষাজীবন শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই কর্মজীবনে যুক্ত হয়ে পড়েন বিদিশা মজুমদার। আগরতলা এবং উদয়পুরের নামি বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে দুই বছরের বেশি সময় শিক্ষকতা করেন তিনি। আই সি এম আর- এ সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবে কয়েক বছর কাজ করেন। পরবর্তীকালে ত্রিপুরা সরকারের শিক্ষা দপ্তরের অধীনে চাকরি পরীক্ষা দিয়ে প্রথমে স্নাতক শিক্ষক এবং পরবর্তীকালে স্নাতকোত্তর শিক্ষক হিসেবে চাকরি পান। ২০১৬ সালে তিনি  স্নাতকোত্তর শিক্ষক হিসেবে হারিআনন্দ ইংলিশ মিডিয়াম হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে কাজ শুরু করেন। এই স্কুলে সাড়ে ৯ বছরের শিক্ষকতায় তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের পুঁথিগত শিক্ষার পাশাপাশি, সংস্কৃতি চর্চা, ব্যবহারিক জ্ঞান সহ বিভিন্ন উদ্ভাবনী ক্ষেত্রে বিশেষ সাফল্যের অবদান রেখেছেন। ২০১৯ থেকে তার নেতৃত্বে হরিআনন্দ স্কুল সহ রাজ্যের বিভিন্ন স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা জাতীয় স্তরের একাধিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করছে এবং সফলতার দাবি রেখেছে। 
 
শিক্ষিকা বিদিশা মজুমদার "শুশ্রু সাইন্স ক্লাব" নামে একটি সাইজ ক্লাব পরিচালনা করেন। বিভিন্ন স্কুলের ছাত্র ছাত্রী যাদের মধ্যে প্রতিভা এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতা রয়েছে কিন্তু বিভিন্ন কারণে তারা তা তুলে ধরতে পারেন না তাদেরকে সুযোগ দেওয়া হয়। চিলড্রেন সাইন্স কংগ্রেস, বাল বিজ্ঞানী প্রদর্শনী, রাজ্য এবং জাতীয় স্তরের একাধিক প্রতিযোগিতা এবং প্রদর্শনীতে তিনি ত্রিপুরার ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
 
একইভাবে শিক্ষিকা বিদিশা মজুমদার নিজেও ইন্ডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল সাইন্স ফেস্টিভালে পোস্টার প্রেজেন্টেশন, পেপার প্রেজেন্টেশন করেছেন। ২০২৩ সালে তিনি ১০৮ তম ইন্ডিয়ান কংগ্রেস সিলেকশনে ত্রিপুরার প্রতিনিধি হয়ে নাগপুর ইউনিভার্সিটিতে অংশ নিয়ে সাফল্য অর্জন করেছিলেন। ২০২৪ সালে গোহাটি আইআইটি-তে অনুষ্ঠিত ইন্ডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল সাইন্স ফেস্টিবলে দুটি ক্যাটাগরিতে অংশগ্রহণ করেন।
 
সেখানে তিনি দিব্যাঙ্গ ছাত্রছাত্রীরা কিভাবে ভয়েস কন্ট্রোল এবং মাইন্ড কন্ট্রোল এর মাধ্যমে হুইল চেয়ার পরিচালনা করতে পারবেন তার উপর প্রেজেন্টেশন করেন। ২০১৯-২০ সালে কোভিড কালীন সময়ে অনলাইনে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সায়েন্স ফিল্ম ফেস্টিভলে তিনি ছাত্রীদের নিয়ে ত্রিপুরার "ডেস্টিনেশন ত্রিপুরা" নামে স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি তৈরি করে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। 
 
রাজ্য এবং জাতীয় স্তরে শিক্ষিকা বিদেশি মজুমদারের ৬০-টির বেশি পুরস্কার এবং শংসাপত্র রয়েছে। ২০২৩ থেকে তিনি শিক্ষক দিবসের এই জাতীয় পুরস্কারের জন্য বাছাই পর্বে অংশগ্রহণ করছিলেন। কিন্তু গত দুই বছরে স্বামীর মৃত্যু সহ বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারণে তিনি সঠিকভাবে নিজেকে তুলে ধরতে পারেননি। তারপরও তিনি নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকেন এবং নিজের শিক্ষকতার যোগ্যতার মাধ্যমে চেষ্টা চালিয়ে যান। চলতি বছরে তিনি নিজের যোগ্যতার মধ্য দিয়ে সেই বাছাই পর্বে শ্রেষ্ঠত্বের দাবি রেখেছেন এবং জাতীয় পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন। কর্মক্ষেত্রের প্রতিকূলতার বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন একটা অংশ সবসময় সমালোচনা এবং প্রতিকূলতা তৈরি করতে চাইবে। কিন্তু এসবে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না।
 
চলার পথে যে সমস্ত প্রতিকূলতা আসবে সেগুলিকে পজিটভ ভাবে নিতে হবে এবং কায়দা করে এগিয়ে যেতে হবে। তিনি বলেন "সমস্যা থাকবেই। সেগুলি পার করেই সাফল্যে পৌঁছাতে হবে।" নিজের এই সাফল্যের জন্য তিনি নিজের মা-বাবা এবং ছাত্র-ছাত্রীদের কৃতিত্বই সবচেয়ে বেশি বলে জানিয়েছেন।
 
প্রসঙ্গত শিক্ষিকা বিদিশা মজুমদারের বাবার বাড়ি উদয়পুরে। স্বামীর বাড়ি আগরতলায়। তার স্বামী ডাক্তার অংকন দত্ত দুই বছর আগে প্রয়াত হয়েছেন। তার ১০ বছরের একটি ছেলে সন্তান রয়েছে। জাতীয় পুরস্কার গ্রহণ করতে তিনি ইতিমধ্যেই আগরতলা থেকে দিল্লী পাড়ি দিয়েছেন। সঙ্গে রয়েছেন ছেলে এবং মা-বাবা। অন্যদিকে ত্রিপুরার এই শিক্ষিকার সাফল্যে উৎসাহ রয়েছে তার পরিবার, ছাত্র-ছাত্রী, সহকর্মী এবং শুভাকাঙ্ক্ষী মহলে।
 
ইতিমধ্যেই ত্রিপুরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিজের সামাজিক মাধ্যমে শিক্ষিকা বিদদিশা মজুমদারের সাফল্য তুলে ধরে তাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। শিক্ষিকা বিদিশা মজুমদারের এই সাফল্য কর্মক্ষেত্রে অন্যদেরকে উৎসাহিত করবে বলে মুখ্যমন্ত্রী আশাব্যক্ত করেছেন।