দেবকিশোর চক্রবর্তী
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার কাঁথি মহকুমার ভূপতিনগর থানার মুগবেড়িয়ার সুয়াদীঘি গ্রাম—ইতিহাসের পাতায় এক অনন্য নাম। গ্রামদেবী মুগেশ্বরীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই জনপদের প্রাচীন ঐতিহ্যের অন্যতম ধারক নন্দ পরিবার। প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের পুরনো এই পরিবারের জমিদারি ইতিহাস যেমন গৌরবময়, তেমনি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও সমাজকল্যাণমূলক কর্মযজ্ঞের সাক্ষী আজও।
মেদিনীপুরের প্রবীণ ইতিহাসবিদ মম্মথ নাথ দাসের গবেষণা অনুযায়ী, সপ্তদশ শতকে হিজলীর পাঠান শাসক তাজ খাঁর মৃত্যুর পর রাজ্য বিভক্ত হলে মাজনামুঠা জমিদারি গড়ে ওঠে। সেই জমিদার রাজা যাদবরাম রায় বৈদিক সংস্কৃতি প্রচারের জন্য উড়িষ্যা থেকে নন্দ, ত্রিপাঠী, ষড়ঙ্গী প্রভৃতি ব্রাহ্মণ পরিবারকে এনে জমি দান করেন। এই নন্দ পরিবারের আদি পুরুষ অপর্তি চরণ নন্দ উড়িষ্যার বিরামচন্দ্রপুর থেকে এসে মুগবেড়িয়ায় স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। তাঁর বংশধর ভোলানাথ নন্দ বিশাল অনাবাদী জমি বন্দোবস্ত নিয়ে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন এবং সমাজসেবায় খ্যাতি অর্জন করেন।
এই ঐতিহ্যেরই ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠে নন্দ পরিবারের শ্যামা মন্দির। পরিবারের প্রাক্তন বিধায়ক অধ্যাপক ব্রহ্মময় নন্দ জানান, “অতীতে খড়ের চালাঘরে মৃন্ময়ী মূর্তির পুজো হত। পরে ১৩৩৬ বঙ্গাব্দে গঙ্গাধর নন্দ বর্তমান পাকা মন্দিরটি নির্মাণ করেন। তাঁর পুত্র বিরজাচরণ নন্দের ইচ্ছানুসারে কাশী থেকে নৌকায় করে আনা কষ্টিপাথরের কালী মূর্তি মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত হয়।”
কয়েক বছর পর নবদ্বীপের এক বৈষ্ণব ব্যক্তি গৌরাঙ্গ মূর্তি নিয়ে আসেন নন্দ পরিবারে। ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব যেমন বলেছিলেন—“কালী ও গৌরাঙ্গ এক”—সেই ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে নন্দ পরিবার একই সঙ্গে কালী ও গৌরাঙ্গের পূজা শুরু করে। আজও মন্দিরে প্রতিদিন শ্যামাসঙ্গীত ও কীর্তনের সুরে মুখরিত হয় প্রাঙ্গণ।
এই মন্দির ঘিরে রয়েছে আরও বহু ঐতিহাসিক কাহিনি। এক সময় এখানেই চারণ কবি মুকুন্দ দাস তাঁর দেশাত্মবোধক গান গেয়ে স্বাধীনতার বার্তা ছড়াতেন। বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু এই মন্দির চত্বরে যুবকদের লাঠিখেলার প্রশিক্ষণ দিতেন, কালীপুজোর সময়ে বসত আখড়া। আবার কিংবদন্তি ঘোষক বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র এই মন্দিরেই বসে একসময় চণ্ডীপাঠ করেছিলেন।
নন্দ পরিবারের সদস্য চৈতন্যময় নন্দ জানান, “মন্দির প্রতিষ্ঠাতা গঙ্গাধর নন্দের ছেলে বিরজাচরণবাবু বলি চালু করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠার আগের রাতে মা স্বপ্নে বলি প্রথা নিষিদ্ধ করার নির্দেশ দেন। তখন থেকেই এখানে নিরামিষ ভোগের প্রথা প্রচলিত হয়।” পুজোর সময় মাকে দেওয়া হয় পঞ্চ ব্যঞ্জন, মিষ্টান্ন ও ফলভোগ—কোনো আমিষ নয়।
আজও দূরদূরান্ত থেকে অসংখ্য ভক্ত পুজো দিতে আসেন মুগবেড়িয়ার এই শতাব্দী প্রাচীন মন্দিরে। কালী ও গৌরাঙ্গের যুগল আরাধনা যেন এই জনপদে ধর্মীয় সহাবস্থার প্রতীক। অতীতের ইতিহাস, আধ্যাত্মিকতা ও মানবিক মূল্যবোধের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ হয়ে উঠেছে নন্দ পরিবারের ঐতিহ্যবাহী শ্যামা মন্দির। প্রতি বছর কালীপুজোর সময় এই মন্দিরই হয়ে ওঠে মুগবেড়িয়ার প্রাণকেন্দ্র—যেখানে একসঙ্গে জাগে ভক্তি, ঐতিহ্য ও গৌরবের আলো।