মুন্নী বেগম , গুয়াহাটি ঃ
বর্ষাতে সৃষ্টি হওয়া বন্যা অনেকের জন্য অভিশাপ হলেও, অনেকের কাছেই এটি আশীর্বাদের মতো। কারণ প্রতিবছর বন্যার কারণে বহু মানুষ ঘরবাড়ি, গবাদিপশু ইত্যাদি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন, যদিও আবার কিছু লোকের জন্য এটি আশার আলো নিয়ে আসে। এমনই একটি অঞ্চল হলো আসামের শ্রীভূমি (করিমগঞ্জ), যেখানে মানুষের জীবিকার প্রধান মাধ্যম হলো কৃষি। কিন্তু এই অঞ্চলগুলো বছরভর প্রায়ই জলের নিচে থাকে, এমনটা বললেও ভুল হবে না। ফলে এখানে মানুষ এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছে, যাকে বলা যেতে পারে চরম দুরবস্থা ।
কিন্তু শ্রীভূমির বদরপুর শহর থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরের আলেখারগুল গ্রামের বাসিন্দা নজরুল হক মাছ চাষের মাধ্যমে এই অঞ্চলে জীবিকার ক্ষেত্রে এক বিপ্লব এনে দিয়েছেন। মাছ চাষের মাধ্যমে তিনি নিজে স্বনির্ভর হওয়ার পাশাপাশি তার গ্রামের প্রতিটি পরিবারের মানুষকেও আত্মনির্ভরশীল করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন।
চাষের মাছে হাতে নজরুল
আওয়াজ দ্য ভয়েসকে মাছচাষি নজরুল হক বলেন,"আমি যে জায়গায় বাস করি, সেখানে সাধারণত মানুষ বলে যে কোনো কাজের সুযোগ নেই। কারণ এখানকার সব মানুষ সাধারণভাবে কৃষিকাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করে। আমিও শুরুতে চাষাবাদ করেই কোনোমতে পরিবার চালাচ্ছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমাদের এখানে ভালোভাবে চাষ করেও টিকে থাকা যায় না। কারণ অধিকাংশ জমি বছরভর জলের নিচে ডুবে থাকে। তাই আমি ভাবলাম, যদি এই জমিগুলো কিছুটা উন্নত করে অন্য কোনো কাজে লাগানো যায়, তাহলে লাভবান হওয়া সম্ভব। আমার মনে প্রথমেই মাছচাষের কথাই এলো, কারণ আমাদের এখানে আগে থেকেই একটি তৈরি মাছের বাজার ছিল।"
নজরুল হকের বাবা পেশায় একজন কৃষক ছিলেন। তাঁদের পরিবারের আর্থিক অবস্থাও খুব একটা ভালো ছিল না, কিন্তু ছোটবেলা থেকেই নজরুলের কিছু করে দেখানোর প্রবল আগ্রহ ছিল। শুরুতে তিনি মাছের ব্যবসা করতে ১০ হাজার টাকার একটি ঋণ নিয়েছিলেন এবং সেই টাকাটির সঠিক ব্যবহার করে সময়মতো ব্যাংকে ফেরত দিয়েছিলেন। সেই থেকেই তার জীবনের পথ খুলে যায়।
বিভিন্ন প্রজাতির মাছ নিয়ে নজরুল
নজরুল বলেন, “নিষ্ঠা এবং সততার সঙ্গে যদি ব্যবসা শুরু করা যায়, তাহলে আর্থিকভাবে স্বনির্ভর হওয়া সম্ভব ।এই বিশ্বাস থেকেই আমি ২০০০ সাল থেকে মাছ চাষের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ি। ২০০৩ সালে রাজ্য সরকারের অধীনে ‘ARIASP’ নামে একটি প্রকল্প আমার জন্য আসে এবং তার পরই মাছ চাষের জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ লাভ করি। শুরুতে আমি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মাত্র ১ হেক্টর জমিতে মাছ চাষ শুরু করেছিলাম। তখন আমি মাত্র ৫ থেকে ৭ কুইন্টাল মাছ উৎপাদন করতে পারতাম। কিন্তু এখন আমি নিজের জমির পাশাপাশি লিজ নেওয়া প্রায় ১০০ হেক্টর জমিতে মাছ চাষ করে মোট ৬-৭ টন মাছ উৎপাদন করছি।”
সরকারি চাকরির জন্য অপেক্ষা করে সময় নষ্ট না করে, স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পরপরই নজরুল মাছ উৎপাদনের উদ্যোগে নামেন। মাছ চাষের মাধ্যমে তিনি নিজে যেমন স্বনির্ভর হয়েছেন, তেমনি বেকার যুবকদের মাঝেও মাছ চাষের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করেছেন। যার ফলে তার গ্রামের মোট ৩০০টি পরিবার মাছ চাষের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে।
মাছ চাষের জন্য আর্থিক সহায়তার উদ্দেশ্যে নজরুল ‘স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া’র বদরপুর শাখার সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং ব্যাংক থেকে যথেষ্ট সুবিধা পাওয়ার পাশাপাশি ব্যাংক নজরুলকে একজন আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করে তার গ্রামটির নাম 'SBI Fisheries Village' হিসেবে ঘোষণা করে।
নয়া দিল্লিতে চেক গ্রহন করেছেন
নজরুল বলেন,"আমি মনে করি, আসামে মাছ চাষের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। আমি নিজেও মাছ চাষ করছি এবং আমার সঙ্গে বহু যুবক জড়িত। মাছের ব্যবসা একটি অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা। শুধু আমাদের কিছু পরিশ্রম করতে হবে। আসামে এমন জায়গা আছে, যেগুলো সারা বছর জলে ডুবে থাকে। উজান থেকে নিন্ম অবধি অনেক পতিত জমি সঠিকভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে না। যদি আমরা এইসব জায়গায় নিজেরাই মাছ চাষ শুরু করি, তাহলে স্বনির্ভর হওয়া সম্ভব। বর্তমানে আমাদের রাজ্যে বাইরের রাজ্য থেকে বিপুল পরিমাণে মাছ আমদানি হচ্ছে। এমন অবস্থায়, যদি আমাদের স্থানীয় মৎস্য উদ্যোক্তারা নিজেরা উৎপাদিত মাছ সরবরাহ করতে পারেন, তাহলে রাজ্যের যুবসমাজ লাভবান হবে এবং মাছচাষ ও মাছের ব্যবসার ক্ষেত্রে রাজ্যটিও এগিয়ে যাবে।"
মাছ চাষ একটি অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা বলে উল্লেখ করে নজরুল প্রতি বছর বেশ ভালো উপার্জন করে আসছেন। তিনি কোনো ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার না করে সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতিতে রুই, কাতল, শিং, মাগুর, কমন কার্প, পাবদা, কৈ, রূপচাঁদা ইত্যাদি মাছ উৎপাদন করে আসছেন। শুধু রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে নয়, বরং উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয়, ত্রিপুরা, মিজোরাম প্রভৃতি রাজ্যেও তিনি তার উৎপাদিত মাছ রপ্তানি করে চলেছেন।
নজরুল বলেন,"মাছ চাষ একটি অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা। আমি নিজে মাছ চাষ করছি, পাশাপাশি আমার গ্রামের সব মানুষই এখন এই পেশার সঙ্গে যুক্ত। তবে কয়েক বছর আগেও মানুষ মাছ চাষ করতে আগ্রহী ছিল না। কিন্তু এখন অনেক শিক্ষিত যুবক এই পেশায় যুক্ত হয়ে পড়েছে, যা আমাদের রাজ্যের জন্য অত্যন্ত শুভ লক্ষণ। আমি শুধু এটুকুই বলতে চাই, মাছ চাষ করে মানুষ স্বনির্ভর হতে পারে। শুধু আমাদের মানসিকতা কিছুটা বদলাতে হবে। আমাদের আশেপাশের জমিগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। আমি যুব সমাজকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মাছ চাষে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানাই।আর আমি নিজেও মাছ উৎপাদনের জন্য নিজস্ব উদ্যোগে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কিছু আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছি। যেমন রি-সার্কুলেটরি অ্যাকুয়া কালচার সিস্টেম (RAS), অক্সিজেনের জন্য এরিয়েটর, মাছের রোগ ও সংক্রমণের জন্য বিশেষ ল্যাব ইত্যাদির ব্যবস্থা করেছি।"
মাছ চাষের মাধ্যমে স্বনির্ভর হওয়া করিমগঞ্জের নজরুল হক বর্তমানে অসংখ্য মানুষের জন্য আদর্শ হয়ে উঠেছেন। রাজ্যে মাছ চাষ করে মৎস্য খাতে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শনের জন্য নজরুল হক একাধিক রাজ্য ও জাতীয় পর্যায়ের পুরস্কার লাভ করেছেন।সম্প্রতি অসম সরকার ঘোষিত রাজ্যের তৃতীয় সর্বোচ্চ সম্মান ‘অসম গৌরব’ পুরস্কার তিনি ৩০ মার্চ রাজ্যপালের হাত থেকে গ্রহণ করেন।
রাজ্যপালের থেকে গৌরব’ পুরস্কার গ্রহন করছেন
তিনি হায়দরাবাদের ভারতীয় কৃষি গবেষণা পরিষদের অধীনস্থ ‘ন্যাশনাল ফিশারিজ ডেভেলপমেন্ট বোর্ড’ (NFDB) থেকেও পুরস্কার পেয়েছেন। গুজরাটের আহমেদাবাদের সায়েন্স সিটিতে সদ্য অনুষ্ঠিত বিশ্ব মৎস্য দিবসের অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় মৎস্য, পশুপালন ও দুগ্ধ বিভাগের প্রতিমন্ত্রী পরশোত্তম রূপালার হাতেও নজরুল এই সম্মান গ্রহণ করেন। এর আগেও তিনি জেলা পর্যায়ে প্রগতিশীল মৎস্য উদ্যোক্তা হিসেবে সম্মানিত হয়েছেন। ভবিষ্যতে মাছের ব্যবসার সম্প্রসারণের পাশাপাশি নজরুল মাছের খাদ্য প্রস্তুতকারক একটি কারখানা খোলার পরিকল্পনাও করেছেন।