ড. ফিরদৌস খান
হরিয়ানার মেওয়াতকে সাধারণত উন্নয়নের দিক থেকে পিছিয়ে পড়া অঞ্চল হিসাবে ধরা হয়। অথচ এখানকার ছেলেমেয়েরা আজ প্রমাণ করে দিয়েছে যে প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও বড় স্বপ্ন দেখা যায় এবং তা পূরণও সম্ভব। তাদের সাফল্যের আলোয় এখন পুরো এলাকা গর্বে উজ্জ্বল। এই কৃতিত্ব শুধু তরুণ প্রজন্মের নয়, তাঁদের পরিবারেরও, যারা নিজেরা কষ্ট সহ্য করেও সন্তানদের পথ তৈরি করে দিয়েছেন। এইসব সফল কন্যাদের মধ্যে সুনারি গ্রামের রুখসানা আজ সবচেয়ে উজ্জ্বল নাম; বর্তমানে তিনি গুরুগ্রামের ম্যাজিস্ট্রেট।
রুখসানার পড়াশোনার যাত্রা শুরু তাওড়ুর মেওয়াত মডেল স্কুল থেকে। দশম শ্রেণি শেষ করার পর তিনি আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চমাধ্যমিক, তারপর সেখান থেকেই বি.এ. এবং এলএলবি সম্পন্ন করেন। উচ্চশিক্ষার প্রতি তাঁর অনুরাগ তাঁকে নিয়ে যায় জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে তিনি এলএলএম ডিগ্রি অর্জন করেন। এখান থেকেই তৈরি হতে থাকে তাঁর নতুন জীবনের ভিত্তি।
একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেওয়ার মুহূর্তে ম্যাজিস্ট্রেট রুখসানা
ম্যাজিস্ট্রেট হওয়াটা ছিল রুখসানার ছোটবেলার স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য তিনি দিনরাত অধ্যবসায় করে গেছেন। প্রথমে হরিয়ানা বিচার পরিষেবার পরীক্ষা দিয়ে ব্যর্থ হন, পরেও উত্তর প্রদেশের পরীক্ষায় সাক্ষাৎকারে সফল হতে পারেননি। তবে ব্যর্থতা তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। সাহস ও অধ্যবসায় নিয়ে তিনি আবার পরীক্ষা দেন, এবার পশ্চিমবঙ্গ বিচার পরিষেবা। অবশেষে সাফল্য ধরা দেয়, এবং তিনি রাজ্যে তৃতীয় স্থান অর্জন করেন। তাঁর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন তখন বাস্তব রূপ পায়।
রুখসানার বক্তব্যে ফুটে ওঠে তাঁর বিনয় ও কৃতজ্ঞতা, তিনি বলেন, পরিবারে, বিশেষত বাবা হলেন তাঁর শক্তি। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই তিনি বিচারক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। যখন বাবাকে তা জানান, বাবা তাকে অকুণ্ঠ সমর্থন দেন। সঠিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি, সবকিছুতে বাবা তাঁর সঙ্গে থেকেছেন। রুখসানার মতে, তাঁর সাফল্যের পেছনে বাবার পরিশ্রমও সমানভাবে জড়িত।
গুরুগ্রামের ম্যাজিস্ট্রেট রুখসানা
রুখসানার মতে, মেয়েদের নিরাপদ ভবিষ্যৎ ও আত্মমর্যাদার প্রথম শর্ত হলো শিক্ষা। পড়াশোনা শুধু জ্ঞানই দেয় না, আত্মবিশ্বাসও তৈরি করে। এবং শুধু পড়াশোনা নয়, হাতে দক্ষতা থাকাটাও জরুরি। শিক্ষিত ও দক্ষ মানুষ কোথাও হারায় না, বরং সমাজের শক্তি হয়ে ওঠে। তাই তিনি অভিভাবকদের প্রতি আবেদন করেন, মেয়েদের উচ্চশিক্ষা থেকে কখনো পিছিয়ে রাখবেন না।
তিনি আরও বলেন, দেশের জন্য একটি সৎ এবং নিষ্ঠাবান বিচারব্যবস্থা খুবই জরুরি। সেই ব্যবস্থার অংশ হতে পেরে তিনি গর্বিত, এবং দেশের সেবায় সর্বোচ্চ দায়িত্ববোধ নিয়ে কাজ করার প্রতিশ্রুতিও দেন।
একটি অনুষ্ঠানে রুখসানাকে সম্মান জানানোর মুহূর্তে
অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইলিয়াস অর্থাৎ রুখসানার বাবা, মেয়ের সাফল্যে অনাবিল গর্ব প্রকাশ করে বলেন, একটি ছোট গ্রামের মেয়ে যে এমন সাফল্য অর্জন করতে পারে, রুখসানা তা প্রমাণ করেছে। তিনি জানান, তাঁর স্ত্রী একসময় রুখসানাকে দ্বাদশ শ্রেণির পর বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু মেয়ের স্বপ্নের প্রতি আস্থা রেখে তিনি তাকে পড়তে উৎসাহ দেন এবং স্ত্রীকেও বোঝান। রুখসানার অধিকাংশ সময়ই কেটেছে পড়াশোনায়, এবং তার ফল আজ সারা এলাকার কাছে অনুকরণীয়।
রুখসানার সাফল্য যেমন পরিবারের জন্য গর্বের, তেমনি অনুপ্রেরণা হয়েছে তাঁর ছোট বোন দিলশানার জন্যও। একই শিক্ষাপথ অনুসরণ করে দিলশানাও এলএলএম করেছেন এবং বিচার পরিষেবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সম্প্রতি হিমাচল প্রদেশের বিচার পরিষেবার সাক্ষাৎকারে তিনি অপেক্ষমাণ তালিকায় স্থান পান। দুই বোনই আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা অ্যাথলিট ছিলেন।
ম্যাজিস্ট্রেট রুখসানাকে সম্মান জানানোর একটি দৃশ্য
রুখসানার বাবা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, নুহ- তে পৌঁছানোর পর জেলা বার অ্যাসোসিয়েশনে যখন তাঁদের ফুল-মালায় অভ্যর্থনা জানানো হয়, সেই মুহূর্ত যেন বর্ণনার অতীত। সেদিনের আনন্দ তিনি ভাষায় প্রকাশ করতে পারেন না।
শেষে তিনি সকল অভিভাবকের প্রতি আবেদন জানান, সন্তানদের নিজেদের পছন্দের ক্যারিয়ার বেছে নিতে দিন। বিশেষত মেয়েদের পড়াশোনায় কখনো কার্পণ্য করবেন না। শিক্ষায় ব্যয় করা অর্থ কোনও অপচয় নয়, বরং সারাজীবনের সেরা বিনিয়োগ।