মৌলানা ড. মোহাম্মদ মকসুদ ইমরান রাশাদি
সানিয়া আঞ্জুম/ বেঙ্গালুরু
বেঙ্গালুরুর কেজে আর মার্কেটের রঙিন কোলাহলে, যেখানে মসলার ঘ্রাণ আর আজানের ধ্বনি মিলেমিশে যায়, সেখানে আশার আলোকবর্তিকা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মৌলানা ড. মোহাম্মদ মকসুদ ইমরান রাশাদি। কর্ণাটকের অন্যতম বৃহত্তম মসজিদ জামিয়া মসজিদের প্রিন্সিপাল, প্রধান ইমাম এবং খতীব হিসেবে তার জীবন ধর্ম, শিক্ষা ও মানবিকতার শক্তির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
ছোট শহরের এক কিশোর হিসেবে দাদা-নানার সামনে বক্তৃতা দেওয়া থেকে শুরু করে হাজারো মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম এক আলেম হওয়ার যাত্রা, মকসুদ রাশাদির পথচলা হলো দৃঢ়তা, সহানুভূতি ও সাহসের এক অসাধারণ কাহিনি। তার সাফল্য আর নীরব বীরত্বের মুহূর্তগুলো আমাদের শেখায়, একজন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি সমাজের বিভাজনকে নিরাময় করে অগ্রগতির আগুন জ্বালাতে পারে।
মৌলানা ড. মোহাম্মদ মকসুদ ইমরান রাশাদি একটি অনুষ্ঠানে
কর্ণাটকের কোলারে জন্ম নেওয়া মকসুদ রাশাদির শৈশব কেটেছে ভালোবাসা ও শিক্ষার আবহে। তার নানা আলহাজ আবদুল গফুর নকশবন্দি, কাপড় ব্যবসায়ী হয়েও জীবনের গভীর শিক্ষা ভালোবাসতেন। তিনি ছোট মকসুদকে অতিথিদের সামনে বক্তৃতা দিতে উৎসাহিত করতেন, আর বলতেন, “মনের ভেতর থেকে বলো।” মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার, “মামলাতের” কলা শিখিয়ে তিনি তার মধ্যে জন্ম দিয়েছিলেন অনন্য বক্তৃতা ও নেতৃত্বের বীজ। শিক্ষক বাবার শাসন, মমতাময়ী মায়ের স্নেহ এবং তিন ভাই–দুই বোনের পরিবারের দ্বিতীয় কনিষ্ঠ হিসেবে তিনি বিনয়, সেবা ও মানবিকতার শিক্ষা পান শৈশবেই।
মুলবাগলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে শুরু হয় তার অসাধারণ শিক্ষা-অভিযান, দশম শ্রেণির পর মাত্র দেড় বছরে কোরআন হাফেজি সম্পন্ন, সাত বছরে ফার্সিসহ আলিম কোর্স শেষ, এবং ২০০১ সালে উর্দুতে এমএ। পরবর্তী সময়ে “মৌলানা মুফতি আশরাফ আলী: হায়াত ও খিদমাত” শীর্ষক তার পিএইচডি গবেষণায় নাত ও নজমের আধ্যাত্মিক সুর গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেন। ১৯৯৯ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে এক বছরের বিনা পারিশ্রমিক সেবা প্রদান করেন, যা ছিল সম্পূর্ণ ভক্তি ও ত্যাগের বহিঃপ্রকাশ। ২০০০ সালে জামিয়া মসজিদে নায়েব ইমাম হিসেবে যোগদান এবং ২০১১ সালে স্থায়ী ইমাম, খতীব ও জামিয়ুল উলুম আরবিক কলেজের প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ ছিল এক রূপান্তরমূলক যাত্রার সূচনা।
মৌলানা ড. মোহাম্মদ মকসুদ ইমরান রাশাদি কিছু ব্যক্তির সঙ্গে
জামিয়ুল উলুমে এসে তিনি দেখলেন, কত তরুণ সুযোগের অভাবে পিছিয়ে পড়ছে। সেই বাস্তবতা বদলাতে তিনি শূন্য থেকে নতুন একটি শিক্ষাবিভাগ গড়ে তোলেন। জামিয়ুল উলুম, শাহিন গ্রুপ এবং খাদিম মোয়মিন ট্রাস্টকে একত্রিত করে সম্পূর্ণ সম্মানী ভিত্তিতে যাত্রা শুরু হয় নতুন শিক্ষাকাঠামোর। বর্তমানে ২০০ আবাসিক, ১০০ ডে স্কলার এবং ১০০ এনআইওএস আবাসিক শিক্ষার্থী ১০ম, পিইউসি এবং ডিগ্রি কোর্সে পড়াশোনা করছে। চার বছর ধরে ১০০% পাশের হার, এমন এক সমাজে যেখানে পড়ালেখা ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা বেশি. তার প্রচেষ্টার ইতিহাস রচনা করেছে। কেজে আর মার্কেটের বস্তির কিশোরী জয়নাব, যার সামনে ছিল বাল্যবিবাহ ছাড়া কোনো ভবিষ্যৎ, মৌলানার উদ্যোগে বিনা খরচে বই ও পরামর্শ পেয়ে পড়াশোনা শেষ করে আজ শিক্ষকতা প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। মকসুদ রাশাদির বিশ্বাস, “জ্ঞান আল্লাহর নূর।”
বিভেদের রাজনীতিতে বিভক্ত এক শহরে শান্তির দূত হিসেবে তার ভূমিকা অপরিসীম। তিনি স্মরণ করেন এক ভয়াবহ চক্রান্তের কথা, দাঙ্গা ছড়াতে কিছু দুর্বৃত্ত মসজিদে পোর্ক এবং মন্দিরের কাছে গরুর মাংস ছুড়ে এসেছিল। কিন্তু তিনি উত্তেজনা না বাড়িয়ে নীরবে তা সরিয়ে দিয়ে সংঘাত রোধ করেন। তার সার্বক্ষণিক আদর্শ, “ইত্তিহাদ মেঁ হি তারক্কি হ্যায়”, ঐক্যই উন্নতি। ২০২৫ সালে “আই লাভ মুহাম্মদ” ব্যানার বিতর্কের সময় দেশজুড়ে উত্তেজনা ছড়ালেও তিনি বলেছিলেন, “ভালোবাসা ব্যানারে নয়, আচরণে।” তার কণ্ঠে শান্তি ও প্রজ্ঞার আহ্বান উত্তেজনাকে নরম করে সংলাপের পথ প্রশস্ত করে। লাউডস্পিকার বিতর্কেও তিনি হিন্দু ও খ্রিস্টান নেতাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সবার জন্য সমান নিয়ম নিশ্চিত করেন। মুসলিম ব্যবসায়ীদের মন্দিরের পাশে এবং হিন্দু ব্যবসায়ীদের মসজিদের কাছে ব্যবসার সুযোগ করে দিয়ে তিনি ভ্রাতৃত্ব ও সহাবস্থানকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন।
মৌলানা ড. মোহাম্মদ মকসুদ ইমরান রাশাদি মহা মিলাদ-উন-নবীর সমাবেশে স্বামী বেলিমঠ শ্রী শ্রী উদয়জির সাথে সাক্ষাতের একটি মুহূর্ত
মুফতি হিসেবে ফতোয়ার ক্ষেত্রেও তিনি ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধকে ভিত্তি করেন। পীর জুলফিকার সাহেবের উপদেশ, “আল্লাহর জন্য কাজ করো, কৃতিত্ব আল্লাহর নামে দাও, ভালোবাসা দিয়ে নেতৃত্ব দাও”, তার রাহবার। মিডিয়ার অপপ্রচার ও চাঞ্চল্য সৃষ্টির বিরুদ্ধে তার ফতোয়া থেকেই জন্ম নেয় #TruthInMedia আন্দোলন, যা তরুণদের মধ্যে আলোড়ন তোলে। ওয়াক্ফ সংশোধনী বিল ২০২৫-এর বিরুদ্ধে তার শান্তিপূর্ণ মানবশৃঙ্খল ন্যায়ের সংগ্রামকে সংঘাত ছাড়াই গণআন্দোলনে রূপ দেয়।
ধর্মীয় সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় নবীজির মীসাক-এ-মদিনাকে প্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করে তিনি জামিয়া মসজিদে সব ধর্মের নেতাদের সংলাপের সুযোগ করে দিয়েছেন। মিশ্র-ধর্ম ইফতারে এক হিন্দু অতিথির মন্তব্য, “আমি এখানে ঠিক মন্দিরের মতো শান্তি পেয়েছি”, তার দৃষ্টিভঙ্গির শক্তিকে উজ্জ্বল করে। ২০২৫ সালের পাহেলগাম সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হলে বেঙ্গালুরু প্রেস ক্লাবে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট ঘোষণা করেন, “সন্ত্রাস কাপুরুষতা, এবং সন্ত্রাসের কোনো ধর্ম নেই। আমরা হিন্দুস্তানকে ভালোবাসি।” তিনি যুবকদের বারবার আহ্বান জানান, “জ্ঞান দিয়ে উগ্রবাদ বর্জন করো, ঐক্য গড়ো” এবং সেই বার্তা আজ অসংখ্য তরুণের হৃদয়ে দেশপ্রেম ও শান্তির চেতনাকে লালন করছে।
সম্প্রতি ইরানের তেহরানে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শান্তি ও ভ্রাতৃত্ব সম্মেলনে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করছেন মৌলানা ড. মোহাম্মদ মকসুদ ইমরান রাশাদি।
কোলারের ধূলিমাখা পথ থেকে জামিয়া মসজিদের স্পন্দিত মিম্বার পর্যন্ত তার যাত্রা, সামাজিক পরিবর্তনের এক অনন্য পাঠশালা। তার উদ্যোগে ৪০০ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ গড়ে উঠছে, শান্তির বাণী বিভাজনের ক্ষত সারাচ্ছে, আর ন্যায়ের জন্য তার সাহসী অবস্থান সমাজকে সঠিক পথে এগিয়ে নিচ্ছে। ১৯,৫০০-এর বেশি ফেসবুক অনুসারী, ইউটিউবে হাজারো দাওয়াহ, পাশাপাশি রমজানের ঘোষণাপত্র, মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া সহ বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক নেতার সঙ্গে সংলাপ, সবকিছুই দেখায় তিনি ঐতিহ্য ও আধুনিকতাকে সুনিপুণভাবে মিলিয়ে এগিয়ে চলেছেন। জামিয়া মসজিদের প্রশস্ত আঙিনায় তার জুম্মার বয়ানের আবেগময় দৃশ্য, ছাত্রদের মনোযোগী অধ্যয়ন, অথবা কেজে আর মার্কেটে হিন্দু–মুসলিম ব্যবসায়ীদের বন্ধুত্বপূর্ণ হাসিমাখা মুখ, এসব দৃশ্যই তার উত্তরাধিকারকে চিরন্তন করে রাখবে।
মকসুদ রাশাদি কেবল একজন ধর্মীয় নেতা নন, তিনি একটি আন্দোলন। তার জীবন আমাদের শেখায়, সবর ও ইহসানের আলোয় বিশ্বাসকে কর্মে রূপান্তর করতে পারলেই বিশ্ব বদলানো যায়। আজ জামিয়া মসজিদের পবিত্র মিম্বার থেকে তার কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হয়, ভেদাভেদ ভেঙে ঐক্যের পথে এগিয়ে যাও। তিনি তার দায় পালন করছেন, এবার পৃথিবী বদলানোর পালা আমাদের।