বিদেশি দেশের লোভনীয় চাকরি ছেড়ে অসমের কৃষিক্ষেত্রে উৎসর্গ করেছেন বনজিত হুসেইন

Story by  Munni Begum | Posted by  Sudip sharma chowdhury • 2 d ago
বনজিত হুসেইনের চাষাবাদ
বনজিত হুসেইনের চাষাবাদ
মুন্নী বেগম ,গুয়াহাটি:

বর্তমান সময়ে যুবক-যুবতীরা উচ্চশিক্ষা লাভ করে কেবলমাত্র সরকারি চাকরির প্রতীক্ষায় থাকে। তবে এর মাঝেও কিছু যুবক-যুবতী চাকরির পরিবর্তে কৃষি এবং ব্যবসার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তেমনই একজন উদ্যোগী যুবক হলেন বনজিত হুসেইন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শিক্ষাগত খ্যাতি অর্জনকারী নলবাড়ির ঘগ্রাপাড়া এলাকার বড়িদতারা গ্রামের যুবক বনজিত হুসেইন কৃষিকাজের মাধ্যমে এক বিপ্লব আনার স্বপ্ন দেখেছিলেন। বর্তমানে বনজিত অসমের একজন সফল কৃষক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং শুধু স্বনির্ভরই হননি,আরও অনেককেই জীবিকার পথ দেখিয়েছেন।
 
"আওয়াজ দ্য ভয়েস"-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে উদ্যমী যুবক বনজিৎ হুসেইন বলেন,"আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে দক্ষিণ কোরিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ বছর কাজ করার সময় আমি কৃষি সংক্রান্ত বিষয়গুলো অনুধাবন করতে শুরু করি। সে সময় চীনের কিছু অধ্যাপকের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় আমি ‘গ্রিন জোন’ প্রত্যক্ষ করি। গ্রিন জোনে একদিনে ১০০ বিঘা জমিতে ধান রোপণ করা হয়। চীন, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া ইত্যাদি দেশে কৃষিকাজে ব্যাপক পরিবর্তন হচ্ছে তা আমি জানতে পারি। তখনই আমাদের বড়ভগা বড়িদতারা গ্রামের খেতি-মাটির কথা আমার মনে পড়ে এবং আমি অসমে কৃষিকাজ করার সংকল্প করি।

তাই ২০১৯ সালে নলবাড়ির ঘগ্ৰাপারার বড়িদতারা গ্রামে আমার বাবা, বিশিষ্ট সাংবাদিক হাইদর হুসেইনের এক খণ্ড কৃষিজমিতে চাষাবাদ করার উদ্দেশ্যে আমি বিদেশ থেকে নিজের বাড়িতে ফিরে আসি এবং বিভিন্ন দেশে কৃষিক্ষেত্রে অর্জিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বড়িদতারা গ্রামে ‘বড়িদতারা’ নামে একটি কৃষি খামার শুরু করি।" 
 
তিতা করলার চাষ
 
নলবাড়ির বড়িদতারা গ্রামে আমাদের ৩০ বিঘা কৃষিজমিতে চাষাবাদ করা হয়। এই কৃষিজমিতে প্রতি বছর ৩–৪ বার ধান, সরিষা ইত্যাদি নানা ধরনের ফসলের চাষ হয়, ফলে ৩০ বিঘা জমিতে ১০০ বিঘা জমির সমান ফসল উৎপাদন হচ্ছে। বড়ো ধান, সরিষা, শালিধানের ক্ষেত্রে অন্য খেতের তুলনায় দ্বিগুণ উৎপাদন করতে সক্ষম হচ্ছেন বলে বনজিৎ হুসেইন "আওয়াজ"কে জানান।

বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে চাষাবাদ করা বনজিৎ হুসেইন একজন প্রতিষ্ঠিত কৃষকই নন, পাশাপাশি একজন সফল উদ্যোক্তাও। কারণ, হুসেইন সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নিজেই মাঠে কাজ করেন এবং নিজের উৎপাদিত পণ্য নিজেই বিক্রিও করে থাকেন।

বনজিৎ হুসেইন বলেন,"আমি কখনোই মেশিন দিয়ে মাড়াই করি না। আমরা জবকা বানিয়ে চাষ করি। অন্য কৃষকদের প্রতি বিঘায় ৮–১০ মণ ধান উৎপাদন হয়, অথচ আমাদের ক্ষেত্রে তা ২০–২৫ মণ পর্যন্ত হয়েছে। বড়ো ধান ৪০ মণ পর্যন্ত উৎপাদন হয়েছে। সরিষার উৎপাদনও বেশি হওয়ায় আমরা বাজারে খাঁটি মিঠা তেল বিক্রি করতে পারছি।"

বনজিৎ হুসেইনের ‘বড়িদতারা’ কৃষি খামারে উৎপাদিত মেম লাহি চাল, তুলসী জোহা, সলিহৈ, ঢেঁকির ছাঁটা গুড়ি, কাকুয়া বাঁও চাল, রঙা বরা চাল, বাও ধানের চিঁড়া, কৃষ্ণ বরা চাল এবং ঘরে পেরা মিঠা তেল সম্প্রতি ভোগালীর বাজারে ক্রেতারা কিনেছেন।
 
শস্য উৎপাদন প্রসঙ্গে হুসেইন বলেন,“বরপেটায় প্রায় চার বিঘা জমিতে ২ টন টমেটো উৎপাদন হয়, কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে ২০–২৫ টন টমেটো উৎপাদন হয়েছে। তবে এত বেশি উৎপাদনের পরও উপযুক্ত বাজারের অভাবে বিপুল পরিমাণ টমেটো নষ্ট হয়ে গেছে। অসমে কৃষকদের জন্য এখন মডেল তৈরি করার চেয়ে উপযুক্ত বাজারের বেশি প্রয়োজন, আর এই বাজারের ব্যবস্থা সরকারকেই দ্রুত করতে হবে।”
 

 
বনজিৎ হুসেইনের  কৃষি কর্ম
 
তিনি আরও বলেন,“রাজ্যে কৃষকরা উৎপাদন বাড়ালেও তারা লাভ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কারণ, কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় সুবিধার অভাব রয়েছে রাজ্যে। এই কারণেই অনেক ক্ষেত্রেই রাজ্যের কৃষকরা পিছিয়ে পড়ছে।”

গ্রামীণ অর্থনীতি প্রসঙ্গে হুসেইন বলেন,“সরকার যে সাবসিডি দেওয়া চাল বিতরণ করে, সেটি আসামের কৃষকদের কাছ থেকেই কেনা উচিত। তবেই রাজ্যের গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী হবে।”

তিনি আরও জানান যে,“পাঞ্জাবে এক হেক্টর জমিতে ৭,৪০০ কেজি ধান উৎপাদন হয়, অথচ অসমে তার অর্ধেকও হয় না। পাঞ্জাবে এক হেক্টরে ধান উৎপাদন করে কৃষক ৮১,০০০ টাকা লাভ করছে, অথচ অসমে গড়ে একজন কৃষকের ৩,০০০ টাকা লোকসান হচ্ছে। এর প্রধান কারণ হলো, কৃষিক্ষেত্রে রাজ্য সরকারকে যে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল, তা সেভাবে গ্রহণ করা হয়নি।”
 

 
নিজের খামের আত্মতৃপ্তির এক দৃশ্য 
 
হুসেইন বলেন,"গ্রামে চাষের সময় ট্রাক্টরের কারণে মাটির উর্বরতা শেষ হয়ে যাচ্ছে। ট্রাক্টর দিয়ে মাটি কেটে তা বিক্রি করা হচ্ছে। এই ধরনের পরিবেশ ধ্বংসকারী কাজ বন্ধ করে যদি কৃষকদের জন্য উপযুক্ত বাজার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়, তাহলে আমাদের রাজ্য কৃষির মাধ্যমে ভারতের সেরা রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে। আমরা কৃষিক্ষেত্রে কাজ করছি এবং আরও ভালোভাবে কাজ করার চেষ্টা করছি।"

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর,বনজিৎ হুসেইন বিভিন্ন ধরনের সামাজিক কাজে যুক্ত ছিলেন। ২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ কোরিয়ার অ্যাংলিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রণক্রমে অধ্যাপনা করেছেন। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে স্বদেশে ফিরে তিনি দিল্লির নেহরু মেমোরিয়াল মিউজিয়ামে কাজ করেছেন এবং জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে আফগানিস্তানের নির্বাচনে নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও তিনি ন্যাশনাল লেবার ইনস্টিটিউটে কাজ করেছেন এবং ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনসহ একাধিক দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছেন।

বনজিৎ হুসেইন বলেন,“এখনও মাঝেমধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও একাডেমিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত থাকি। এখনও আমি দিল্লি গেলে কোনো না কোনো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেতে পারি। কিন্তু আমি অসমে কৃষির মাধ্যমে একটি আদর্শ স্থাপন করে আত্মনির্ভরশীল হতে চাই।”