নোবেল পুরস্কার ২০২৫: ওমর এম.ইয়াগির আবিষ্কার বিজ্ঞানকে মানবতার ত্রাণকর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে
Story by atv | Posted by Sudip sharma chowdhury • 2 d ago
রসায়ন বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ওমর এম. ইয়াগি
আর্ছলা খান / নতুন দিল্লী
বিজ্ঞানের জগতে এ বছরের রসায়নে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছেন তিনজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী—সুচুমু কিদোকাওয়া, রিচার্ড রবসন, এবং ওমর এম.ইয়াগি। তাঁদের এই সম্মান প্রদান করা হয়েছে ‘মেটাল–অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্কস (Metal–Organic Frameworks - MOFs)’ এবং ‘কোভালেন্ট অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্কস (Covalent Organic Frameworks - COFs)’-এর বিকাশে অসামান্য অবদানের জন্য।
এই আবিষ্কারগুলি শুধু রসায়ন বিজ্ঞানে নয়,পরিবেশ, শক্তি, এবং জল সংরক্ষণ ক্ষেত্রেও গভীর প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে ওমর এম. ইয়াগি-র গবেষণায় গোটা বৈজ্ঞানিক সমাজের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে।
তিনি এমন এক সূক্ষ্ম ও শক্তিশালী রাসায়নিক কাঠামো উদ্ভাবন করেছেন, যা জল সংকট মোকাবিলা, কার্বন নির্গমন নিয়ন্ত্রণ, এবং পরিবেশ পুনরুদ্ধারে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। তাঁর নেতৃত্বে বিকশিত MOFs এবং COFs বর্তমানে আধুনিক রসায়ন বিজ্ঞানের অন্যতম যুগান্তকারী ও কার্যকর আবিষ্কার হিসেবে স্বীকৃত।
ওমর এম. ইয়াগি
উমর মুনিছ ইয়াগি — আধুনিক রসায়নবিজ্ঞানের পথিকৃৎ।উমর এম. ইয়াগির সম্পূর্ণ নাম উমর মুনিছ ইয়াগি। তাঁর জন্ম ১৯৬৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি, জর্ডানের আম্মান শহরে। পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁর এমন সব উদ্ভাবন রয়েছে, যা স্বচ্ছ শক্তি, জল সংকট, কার্বন আহরণ (carbon capture) এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণসহ বহু বৈশ্বিক সমস্যার বাস্তবসম্মত সমাধান এনে দিয়েছে। তাঁকে বিশ্ববিজ্ঞান মহলে “মেটাল–অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্কস (Metal–Organic Frameworks – MOFs)”-এর পিতৃপুরুষ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
ইয়াগির গবেষণা রেটিকুলার রসায়ন (Reticular Chemistry)-এ এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। এই শাখায় অণুসমূহকে সুনির্দিষ্টভাবে যুক্ত করে উচ্চ-শৃঙ্খলিত, ছিদ্রযুক্ত স্ফটিকীয় গঠন তৈরি করা হয়—যেমন মেটাল–অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্কস (MOFs) এবং কোভালেন্ট অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্কস (COFs)। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে স্বচ্ছ শক্তি উৎপাদন, জল সংকট মোকাবিলা, কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবেশ সংরক্ষণে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে।
ইয়াগির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন হল বায়ু থেকে জল আহরণযন্ত্র—যা শুকনো ও মরুভূমি অঞ্চলের জন্য এক আশীর্বাদস্বরূপ। তাঁর নেতৃত্বে বিকশিত মেটাল–অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্কস (MOFs) বায়ুর আর্দ্রতা শোষণ করে তা পানযোগ্য জলে রূপান্তরিত করতে সক্ষম। এই উদ্ভাবন সাহারা, আরব উপদ্বীপ এবং ভারতের রাজস্থান-এর মতো শুষ্ক অঞ্চলে জলসংকট নিরসনের এক নতুন পথ দেখিয়েছে।
ওমর ইয়াগি — বিজ্ঞান ও প্রকৃতির সহাবস্থানের পথে,ওমর ইয়াগি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,“আমাদের লক্ষ্য এমন উপাদান তৈরি করা, যা প্রকৃতির সঙ্গে সংঘাত নয়, বরং সহযোগিতা করে।”তাঁর এই ভাবনা আজ টেকসই বিজ্ঞান (Sustainable Science)-এর ক্ষেত্রে এক গভীর ও শক্তিশালী বার্তা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ইয়াগির উদ্ভাবিত মেটাল–অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্কস (Metal–Organic Frameworks - MOFs) বিশ্বজুড়ে ক্রমবর্ধমান গ্রীনহাউস গ্যাসের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। এই কাঠামোগুলি বায়ু থেকে নির্বাচনমূলকভাবে কার্বন ডাই–অক্সাইড সংগ্রহ করে এবং তা পুনর্ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণ করতে সক্ষম।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রযুক্তি ভবিষ্যতে শিল্প নির্গমন নিয়ন্ত্রণে (Industrial Emission Control) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। অনেক দেশ ইতিমধ্যেই MOF-ভিত্তিক পদ্ধতি তাদের কার্বন সংগ্রহ ও সঞ্চয় (Carbon Capture and Storage – CCS) কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।ওমর এম. ইয়াগি — বিজ্ঞানী এবং পরিবেশ সংস্কারক
ওমর এম. ইয়াগি শুধু একজন রসায়নবিদ নন, তিনি একজন পরিবেশ সংস্কারক হিসেবেও পরিচিত। জর্ডানে জন্মগ্রহণ করে আমেরিকায় বেড়ে ওঠা ইয়াগি বিজ্ঞানকে কখনও পরীক্ষাগারের ভেতরে সীমাবদ্ধ রাখেননি।
তিনি ‘গ্লোবাল সায়েন্স ইনিশিয়েটিভ’ (Global Science Initiative)-এর মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলির তরুণ-তরুণীদের উদ্ভাবন ও গবেষণার জন্য অনুপ্রাণিত করেন। তাঁর বিশ্বাস — আসল আবিষ্কার সেই যা মানবজীবনের উন্নতি সাধন করে।
তাঁর গবেষণাগারে বিকশিত ধারণাগুলি জল সংকট, দূষণ ও শক্তি সংকটের মতো বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় বিজ্ঞানের ভূমিকা নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, ইয়াগির উদ্ভাবিত প্রযুক্তিসমূহ ভবিষ্যতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (Sustainable Development Goals - SDGs) অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদদের দৃষ্টিতে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইয়াগির এই আবিষ্কারকে “একটি শক্তিশালী বৈজ্ঞানিক অস্ত্র” হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। ওমর ইয়াগির গবেষণাগারে পরিচালিত পরীক্ষাগুলি প্রমাণ করেছে যে বিজ্ঞান ও পরিবেশ সংরক্ষণ পাশাপাশি এগিয়ে যেতে পারে।ওমর ইয়াগির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা নতুন বৈজ্ঞানিক দিগন্ত ।
ওমর ইয়াগির নেতৃত্বে বিকশিত এই কাঠামোর শক্তি সঞ্চয়, গ্যাস পৃথকীকরণ, এবং ঔষধ রসায়ন-এর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার রয়েছে। মেটাল–অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্কস (MOFs)-এর ক্ষুদ্র ঝিল্লি–সদৃশ (membrane-like) গঠন এটিকে গ্যাস সংরক্ষণ ও নিয়ন্ত্রিত রাসায়নিক বিক্রিয়ার জন্য বিশেষভাবে উপযুক্ত করে তোলে। উদাহরণস্বরূপ, হাইড্রোজেন সংরক্ষণের ক্ষেত্রে MOFs-এর ব্যবহার একটি পরিশুদ্ধ শক্তিনির্ভর ভবিষ্যতের পথে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
অন্যদিকে, COFs (Covalent Organic Frameworks)-এর সহায়তায় ইয়াগি আণবিক স্তরে রাসায়নিক প্রকৌশলের (molecular chemical engineering) এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছেন। এই কাঠামোগুলি জৈব উপাদানের ওপর ভিত্তি করে তৈরি, এবং এগুলি সৌর শক্তি আহরণ, পানিশোধন, ও দূষক নির্গমন নিয়ন্ত্রণ–এর মতো বিশেষ প্রয়োগক্ষেত্রে ব্যবহার করা সম্ভব।
নোবেল কমিটি একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে যে এই পুরস্কারটি ‘বিজ্ঞান ও সমাজের মধ্যে সেতুবন্ধন গড়ে তোলা উদ্ভাবনসমূহ’ এর প্রতি উৎসর্গীকৃত, যা আগামি দশকে মানবতার পথ নির্দেশ করবে। সূচুমু কিডাকাওয়া এবং রিচার্ড রবচন যে মৌলিক নীতিগুলোর ওপর কাজ করেছিলেন, সেগুলোকে ওমর ইয়াগি বাস্তব ও ব্যবহারিক আকারে রূপান্তরিত করেছেন।
জলবায়ু সংকট, দূষণ এবং সম্পদের সংকটের সাথে লড়াই করছে এমন বিশ্বে ওমর ইয়াগির এই গবেষণা প্রমাণ করে যে বিজ্ঞান শুধুমাত্র পরীক্ষাগারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি পৃথিবীর ভবিষ্যতের সমাধানও হতে পারে। ২০২৫ সালের রসায়নবিজ্ঞান নোবেল পুরস্কার কেবল তিনজন বিজ্ঞানীর কৃতিত্ব নয়, এটি এক মানবিক ভবিষ্যতের প্রতি আস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, যেখানে উদ্ভাবন এবং প্রকৃতি একসাথে এগিয়ে যাবে।