মুকুট শর্মা , গুয়াহাটি ঃ
সত্রীয়া নৃত্য হল ভারতের সংগীত নাটক একাডেমি কর্তৃক স্বীকৃত আটটি শাস্ত্রীয় নৃত্যশৈলীর একটি। প্রায় ১৫শ শতক থেকে অসমে প্রচলিত এই নৃত্যশৈলী মহাপুরুষ শ্রীমন্ত শঙ্করদেব প্রতিষ্ঠিত সত্রগুলির মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে। এই সত্রীয়া নৃত্যকে নতুন প্রজন্মের মধ্যে জনপ্রিয় করে তোলার সংকল্প নিয়েছে অসমের এক বিরল প্রতিভাসম্পন্ন নৃত্যশিল্পী,আরিশ্বা শেখ।সত্রিয়া নৃত্য, ভরতনাট্যম, বিহু নৃত্য এবং অভিনয়ে দক্ষ ১৭ বছর বয়সী আরিশ্বা ইতিমধ্যেই দেশ-বিদেশে প্রশংসা অর্জন করেছে। তবে, আধুনিকতার নামে সত্রীয়া নৃত্যের প্রচলিত ধারা এবং এর বিশুদ্ধতাকে ব্যাহত করতে সে মোটেও রাজি নয়।
‘আওয়াজ – দ্য ভয়েস’-এর সঙ্গে এক টেলিফোনিক আলাপচারিতায় উদীয়মান শিল্পী আরিশ্বা শেখ বলেন,"আমি সত্রীয়া নৃত্যকে নতুন প্রজন্মের মধ্যে জনপ্রিয় করে তুলতে চাই এবং দেশের সীমানা ছাড়িয়ে এই শিল্পর প্রসারে ভবিষ্যতেও কাজ করে যেতে চাই। তবে, আমরা এর বিশুদ্ধতা ও ঐতিহ্য পূর্বের মতোই অটুট রাখতে চাই। জনপ্রিয়তা অর্জনের স্বার্থে বা আধুনিকতার নামে আমাদের প্রিয় সত্রীয়া শিল্পের ঐতিহ্যে আঘাত হানতে দেব না। পাশাপাশি, ‘গুরু-শিষ্য পরম্পরা’ যেন সর্বদা বজায় থাকে, সেই কামনাও করি।"
সত্রীয়া নৃত্য পরিবেশনায় আরিশ্বা শেখ
"সত্রীয়া নৃত্যে ‘বিশারদ’ ডিগ্রি অর্জনের মাধ্যমে আমি যদিও আমার শিক্ষাজীবন সম্পূর্ণ করেছি, তবুও আমি মনে করি এই শিল্পরূপের জটিল দিকগুলো অনুধাবন করার যাত্রা আমার এখনই শুরু হয়েছে। আমি নিজেকে এখনও একজন শিক্ষার্থী হিসেবেই দেখি।"
উল্লেখ্য, আরিশ্বা শেখ হলেন গুয়াহাটির বাসিন্দা আরমান শেখ ও আনজুমা শেখের কনিষ্ঠ কন্যা। গুয়াহাটির বেতকুচিস্থ রয়্যাল গ্লোবাল স্কুল থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পাশ করেন।নৃত্যের প্রতি তাঁর গভীর আকর্ষণ খুবই ছোটবয়স থেকেই প্রকাশ পেয়েছিল। আরিশ্বা ২০০৯ সালের ১৫ আগস্ট ‘প্রাগ চ্যানেল’-এ সম্প্রচারিত একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে কয়েকটি নৃত্য পরিবেশন করেন এবং তাঁর প্রতিভার প্রথম ঝলক দেখান। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৩ বছর।
শৈশব থেকেই নৃত্যের প্রতি আরিশ্বার গভীর আগ্রহ লক্ষ্য করে তাঁর বাবা-মা তাঁকে পদ্মশ্রী ইন্দিরা পি.পি. বড়ার তত্ত্বাবধানে ভরতনাট্যম শেখাতে শুরু করেন।আরিশ্বা বলেন, “আমি ২০১১ সালে, ৫ বছর বয়সে ভরতনাট্যম শেখা শুরু করি, আর ৭ বছর বয়সে সত্রীয়া নৃত্য শেখা শুরু করি। সত্রীয়া নৃত্যের জন্য আমি নর্তন কলা নিকেতন-এ ভর্তি হই। সেখানে সংগীত নাটক একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী রামকৃষ্ণ তালুকদার ও তাঁর স্ত্রী, বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী রুমি তালুকদারের তত্ত্বাবধানে সত্রীয়া শিল্প ও সংস্কৃতি শেখার গৌরব অর্জন করি। তাঁদের তত্ত্বাবধানে আমি সম্প্রতি 'বিশারদ' ডিগ্রি লাভ করেছি এবং গত জানুয়ারি মাসে আমার সত্রীয়া নৃত্যের ‘রংগ যাত্রা’ পরিবেশন করি।”
গুরুর আশীর্বাদ নেবার সময়ে আরিশ্বা শেখ
সত্রীয়া নৃত্যের ক্ষেত্রে দূরদর্শন কেন্দ্রের ‘বি-গ্রেড’ সার্টিফিকেটধারী শিল্পী আরিশ্বা শুধু অসম নয়, সারা ভারতের নানা প্রান্ত—যেমন মুম্বাই, পুরী, বেঙ্গালুরু, দিল্লি ইত্যাদিতে অসংখ্য দর্শককে সত্রীয়া নৃত্যের মাধ্যমে মুগ্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন। কেনিয়ার নাইরোবিতে অনুষ্ঠিত রাউন্ড স্কোয়ার আন্তর্জাতিক সম্মেলন ২০২৩-এ তিনি সত্রিয়া নৃত্য পরিবেশন করার সুযোগ পান, যা ছিল একটি আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাঁর সত্রীয়া নৃত্যের শৈলীকে তুলে ধরার সুবর্ণ সুযোগ।
সত্রীয়া নৃত্যের প্রতি কীভাবে আগ্রহ জন্মাল এই প্রশ্নের উত্তরে আরিশ্বা বলেন,“একদিন আমার মা একটি 'ভোরতাল' নৃত্য দেখে অভিভূত হয়েছিলেন। তার পর থেকেই তিনি আমাকে সত্রীয়া শেখার জন্য নৰ্তন কলা নিকেতনে ভর্তি করাতে উৎসাহিত করেন। এই নৃত্যশৈলীর প্রতি আমার গভীর প্রেম গড়ে ওঠে খুব দ্রুত। সত্রীয়া নৃত্যের নির্মল সৌন্দর্য ও অন্তর্নিহিত গভীরতা আমাকে গভীরভাবে মুগ্ধ করেছে।”উল্লেখযোগ্য যে, ২০২৩ সালে আরিশ্বা বজালীর পাঠশালায় 'Sanskriti Sangam' নামে একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেখানে তিনি 'অভিমন্যু বধ' নামক একটি নাটকে 'দ্রোণাচার্য'-এর চরিত্রে অভিনয় করে সংস্কৃতিপ্রেমী দর্শকদের হৃদয়ে গভীর ছাপ ফেলেন।
এই অনুষ্ঠানের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে আরিশ্বা বলেন,“সপ্তর্ষিদের অন্যতম দ্রোণাচার্যের চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পাওয়া আমার কাছে অত্যন্ত সম্মানের। এই চরিত্রের মনস্তত্ত্বের গভীরতাকে উপলব্ধি করা, তাঁর প্রজ্ঞা ও অন্তর্দ্বন্দ্বকে মূর্ত করে তোলা এক চরম আত্মিক অভিজ্ঞতা ছিল। প্রতিটি পদক্ষেপে, প্রতিটি অভিব্যক্তিতে আমি দ্রোণাচার্যের অন্তর্জগতে প্রবেশের চেষ্টা করেছি। আমার গুরু যে ভরসা রেখেছিলেন, তা পূরণ করার জন্য আমি চরিত্রটিকে জীবন্ত করে তোলার অঙ্গীকার করেছিলাম এবং পূর্ণ নিষ্ঠা ও মনোযোগ সহকারে সেটি মঞ্চে উপস্থাপন করেছি।”
সত্রীয়া নৃত্যে উৎকৃষ্টতার জন্য তাঁকে সম্মান প্রদান
নৃত্যের প্রতি নিষ্ঠা ও কঠোর পরিশ্রমের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ভরতনাট্যম বিভাগে লক্ষ্ণৌয়ের ভাটখণ্ডে’র অধীনে ‘বিশারদ পয়েন্ট ২’ সনদ লাভ করেন।কলকাতায় ভরতনাট্যমের সম্মানিত গুরু রাম বৈদ্যনাথনের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত একটি কর্মশালায় অংশগ্রহণ করে আরিশ্বা তার নৃত্যদক্ষতাকে আরও সমৃদ্ধ করার সুযোগ পেয়েছেন।তাঁর প্রতিভা কেবল সত্রীয়া ও ভরতনাট্যমেই সীমাবদ্ধ নয়, একজন নৃত্য বিশেষজ্ঞ হিসেবেও তিনি কৃতিত্ব অর্জন করেছেন।পশ্চিমী নৃত্যে তিন বছরের ডিপ্লোমা অর্জন করা আরিশ্বা 'The Danceworx' থেকে পরিচালিত PDC (Professional Dance Certification Program)-এর 'Pre-foundation Level' সার্টিফিকেটও অর্জন করেছেন।বিহু নৃত্যে তাঁর মনোমুগ্ধকর পরিবেশনের জন্য আরিশ্বা ‘মৌ কুঁয়রী’ উপাধিতে সম্মানিত হন এবং অসংখ্য প্রশংসাও কুড়িয়েছেন। একটি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও সত্রীয়া সংস্কৃতি, অভিনয় কিংবা বিহু নৃত্যের জগতে এগিয়ে যাওয়ার পথে আরিশ্বা কখনো কোনো বাধা বা সমালোচনার সম্মুখীন হননি। তিনি বলেন, “আমি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান যে আমার জন্ম একটি সংস্কৃতিমনস্ক পরিবারে হয়েছে। ছোটবেলা থেকেই ঘরে শিল্প-সংস্কৃতির পরিবেশ দেখেছি। মা-বাবা খুব ছোটবেলায়ই আমার প্রতিভা চিনতে পেরেছিলেন এবং নৃত্য ও অভিনয়ের জগতে এগিয়ে যাওয়ার জন্য শুরু থেকেই আমাকে অনুপ্রাণিত করে এসেছেন।”
আরিশ্বা ২০২১ সালে নৃত্যক্ষেত্রে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে রয়্যাল গ্লোবাল স্কুলের ‘The Telegraph Award’-এর জন্য মনোনীত হন। এছাড়াও, তিনি IDDF গুয়াহাটির ‘Future Face Award’ দুইবার লাভ করেন ২০১৯ সালে ভরতনাট্যমে পারদর্শিতার জন্য এবং ২০২২ সালে সত্রীয়া নৃত্যে উৎকৃষ্টতার জন্য তাঁকে এই সম্মান প্রদান করা হয়।
নৃত্যদক্ষতার পাশাপাশি আরিশ্বা শেখ গুৱাহাটী আর্টিস্ট গিল্ড-এ সূক্ষ্ম শিল্পের তিন বছরব্যাপী একটি কোর্সের মাধ্যমে তাঁর শিল্প-সাহিত্য ও সৃজনশীল দক্ষতাও সুন্দরভাবে গড়ে তুলেছেন। অভিনেতা বাহারুল ইসলাম এবং অভিনেত্রী ভাগীরথী বাই কদমের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত তিন মাসব্যাপী একটি নাট্য কর্মশালায় অংশ নিয়ে তিনি অভিনয়ে তাঁর প্রতিভাকে আরও উন্নত করার সুযোগ পেয়েছেন।ইতিমধ্যে,কয়েকটি টেলিভিশন সিরিয়ালে অভিনয়ের মাধ্যমে ছোট পর্দায় আত্মপ্রকাশ করা আরিশ্বা জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী কল্পনা পাটওয়ারীর সঙ্গে ‘মণিকূট’ নামের একটি অ্যালবামেও কণ্ঠ দিয়েছেন।