মুসলমান সৈনিকে ভরে ছিল আজাদ হিন্দ ফৌজ

Story by  atv | Posted by  Sudip sharma chowdhury • 10 d ago
নেতাজী সুভাষ চন্দ্ৰ বসু
নেতাজী সুভাষ চন্দ্ৰ বসু
 
সাকীব সেলিম

নেতাজী সুভাষ চন্দ্ৰ বসুর নেতৃত্বতে গঠন করা এবং তাঁর নেতৃত্ব প্রদান করা আজাদ হিন্দ সরকার (মুক্ত ভারত সরকার) ও  তাঁর সশস্ত্ৰ বাহিনী আজাদ হিন্দ ফৌজে (ভারতীয় জাতীয় সেনা)আমাদের স্বাধীনতা সংগ্ৰামীদের দ্বারা পরিকল্পনা করা ভারতের এক উদাহরন উপস্থাপন করেছিল। ভারতের হিন্দু,মুসলমান,শিখ এবং খ্ৰীষ্টানরা এক সার্বজনীন লক্ষ্য,মাতৃভূমির মুক্তির জন্য এক সাথে লড়াই করেছিল। ১৯৩০ র দশকের থেকে  নেতাজী তাঁর মতামত ব্যক্ত করেছিলেন যে ব্ৰিটিস সরকারে ভারত ত্যাগ করার পুৰ্বে দেশকে ধৰ্মীয় বিভাজনে বিভক্ত করার চেষ্টা করবেন। নেতাজীয়ে বিশ্বাস করতেন যে ব্ৰিটিসরা ভারত ত্যাগ করার পুৰ্বে দেশকে চিরদিনের জন্য্য  ধৰ্মীয় বিভাজনে বিভক্ত করে যাবে। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগষ্ট এই ভবিষ্যতবাণী বাস্তবে পরিণত হয়েছিল।

আমি আমার প্রবন্ধটি এই কারণে লিখেছি যে বর্তমান সময়ে ভারতীয় মুসলমানদের দেশপ্রেমকে সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে এবং তাদের পূর্বপুরুষদের ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। আমি আজাদ হিন্দ সরকারের মুসলমানদের ভূমিকার নিয়ে আলোকপাত করে এই প্রবন্ধটি লিখতে যাচ্ছি। নেতাজি জানতেন এবং উৎসাহিত হতেন যে আমি আজ তাঁর আজাদ হিন্দুস্তানীদের তাদের দাবিকৃত ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে শ্রেণীবদ্ধ করছি।  স্বার্থন্যাসী রাজনীতিবিদরা আমাদের এমন এক পর্যায়ে ঠেলে দিয়েছে,যেখানে আমি আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈনিকদের তাদের ধর্ম অনুযায়ী পরিচয় দিতে বাধ্য হচ্ছি। আমার এই প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য প্রমাণ করা যে নেতাজীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনটি প্রকৃত অর্থেই ধর্মনিরপেক্ষ ছিল এবং মুসলমানসহ সকল ভারতীয়ই তার সাথে একতাবদ্ধ হয়েছিল।

আজাদ হিন্দ ফৌজে নেতাজীকে অনুসরণকারী হাজার হাজার মানুষ ছিলেন এবং তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই ইসলাম ধর্মাবলম্বী ছিলেন। তাঁদের সবার বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়। তবে আমি আজাদ হিন্দ ফৌজের কিছু বিশিষ্ট মুসলিম সৈনিকের একটি তালিকা তুলে ধরলাম।

আবিদ হাসান সাফরানি


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, যখন নেতাজী জার্মানির বার্লিনে অবস্থান করছিলেন,তখন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র আবিদ হাসান তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আবিদ ছিলেন হায়দরাবাদের এক ভারতীয় তরুণ। তিনি নেতাজীর আন্দোলনে যোগ দেন এবং পরে তাঁর সচিব ও দোভাষী হিসেবে কাজ করেন। নেতাজী যখন জার্মানি থেকে জাপানে তিন মাসব্যাপী সাবমেরিন যাত্রা করেন, তখন আবিদই ছিলেন সেই যাত্রায় তাঁর সঙ্গে যাওয়া একমাত্র ভারতীয়। পরবর্তীতে, আজাদ হিন্দ ফৌজে এক অফিসার হিসেবে, আবিদ নেতাজীর ব্যক্তিগত পরামর্শদাতা হন এবং বার্মার সম্মুখ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। আজাদ হিন্দ ফৌজের জনপ্রিয় স্লোগান "জয় হিন্দ"এর সৃষ্টিও আবিদেরই।
 

হাবিব উর রহমান


কর্ণেল হাবিব উর রহমান,জেনারেল মোহন সিংয়ের সঙ্গে আজাদ হিন্দ ফৌজের অন্যতম সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এবং তিনি মুখ্য দপ্তরের প্রশাসনিক শাখার দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি বার্মা অভিযানেরও নেতৃত্ব দিয়েছেন। পরে,যখন নেতাজী আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন,হাবিবকে প্রশিক্ষণ বিদ্যালয়ের প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ১৯৪৩ সালের ২১ অক্টোবর,আজাদ হিন্দ সরকার গঠিত হলে, তিনি একজন মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান হন এবং ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট নেতাজীর সঙ্গে তাঁর শেষ বিমানযাত্রায় অংশ নেন।

মেজর জেনারেল মোহাম্মদ জামান খান কিয়ানী


আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রাথমিক গঠনকালে,জেনারেল মোহন সিংয়ের অধীনে মোহাম্মদ জামান খান কিয়ানী ছিলেন সাধারণ কর্মচারী বিভাগের প্রধান। পরে, নেতাজী আন্দোলনের দায়িত্ব গ্রহণ করলে,তিনি কিয়ানীকে প্রথম বিভাগের মন্ত্রী ও কমান্ডার নিযুক্ত করেন। তাঁর নেতৃত্বাধীন বিভাগে তিনটি রেজিমেন্ট ছিল নেহরু,আজাদ ও গান্ধী। এই বাহিনীর নেতৃত্বে তিনি বার্মা সীমান্তে সম্মুখ যুদ্ধ পরিচালনা করেন। যখন নেতাজী সিংগাপুর ত্যাগ করেন এবং হাবিব উর রহমানের সঙ্গে তাঁর শেষ বিমানযাত্রায় বের হন,তখন সেনাবাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব কিয়ানীকেই অর্পণ করা হয়।


সৈনিকদের সঙ্গে নেতাজী

কর্ণেল এহসান কাদির:যখন জেনারেল মোহন সিং আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করেছিলেন,তখন এহসান কাদিরকে আজাদ হিন্দ রেডিওর উপস্থাপক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। ১৯৪৩ সালে যখন রাসবিহারী বসু নেতাজীর হাতে আন্দোলনের নেতৃত্ব তুলে দেন, তখন কাদির সামরিক সচিব হিসেবে আজাদ হিন্দ সরকারে যোগ দেন। তিনি আজাদ হিন্দ দলের নেতৃত্ব দেন এবং ৩০,০০০-এরও বেশি সদস্যবিশিষ্ট স্বেচ্ছাসেবক গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দেন। হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রচারের উদ্দেশ্যে নেতাজী একটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পরিষদ গঠন করেছিলেন এবং কাদিরকে তার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এই পরিষদ নিশ্চিত করেছিল যে আজাদ হিন্দ ফৌজে ধর্মীয় বিভেদ সৃষ্টি না হয়। পরে,যখন কেউ তাকে জানায় যে নেতাজী বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেছেন,তখন কাদির মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।

কর্ণেল ইনায়াতুল্লাহ হাসান: ইনায়াতুল্লাহ হাসানকে জেনারেল মোহন সিং আজাদ হিন্দ রেডিওর উপস্থাপক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তিনি জনপ্রিয় দেশপ্রেমমূলক রেডিও নাটক রচনা করেছিলেন,যার কারণে অল ইন্ডিয়া রেডিও বাধ্য হয় ভারত থেকে পাল্টা সম্প্রচার করতে। পরে নেতাজী তাকে প্রশিক্ষণ বিভাগের দায়িত্ব দেন,যেখানে তিনি নারী,শিশু ও সাধারণ নাগরিকদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন।

মেজর জেনারেল শাহনওয়াজ:মেজর জেনারেল শাহনওয়াজ খানকে নেতাজী ব্রিটিশ-নিয়ন্ত্রিত ভারতের অঞ্চলগুলিতে আক্রমণের জন্য বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। তিনি আরাকান,নাগাল্যান্ডসহ বিভিন্ন সীমান্ত অঞ্চলে আক্রমণের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। যুদ্ধবন্দি ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাদের তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। যুদ্ধের পর আজাদ হিন্দ ফৌজের অফিসারদের যখন গ্রেফতার করে আদালতে তোলা হয়,তখন সমগ্র জাতি তাদের পাশে দাঁড়ায় এবং “লাল কেল্লা সে আয়ি আওয়াজ ধিলন,সেহগাল,শাহনওয়াজ” বলে গর্জে ওঠে।

কর্নেল শওকত আলী মালিক:কর্নেল শওকত আলী মালিক মুক্ত ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলনের গৌরব অর্জন করেছিলেন। ১৯৪৪ সালের ১৪ এপ্রিল, আজাদ হিন্দ ফৌজের 'বাহাদুর' ইউনিটের কমান্ডার মালিক মণিপুরের মোইরাং-এ জাতীয় ত্রিবর্ণ পতাকা উত্তোলন করেন। সেখানে একটি অসামরিক সরকার স্থাপন করা হয় এবং সেখান থেকে গুপ্তচর দল পাঠানো হয় শত্রু সীমান্তে। নেতাজী তাঁকে “তামঘা-ই-শরাফ-ই-জঙ্গ”(Tamgha-e-Sharaf-e-Jang)প্রদান করেন,যা আজাদ হিন্দ ফৌজের অন্যতম সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান ছিল।


জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু

কর্নেল মেহবুব আহমেদ:কর্নেল মেহবুব আহমেদ ছিলেন আজাদ হিন্দ সরকার এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের মধ্যে একজন যোগাযোগ অফিসার। আরাকান ও ইম্ফলের যুদ্ধ চলাকালে তিনি মেজর জেনারেল শাহনওয়াজ খানের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেন।

করিম ঘানি:করিম ঘানি বার্মায় বসবাসরত একজন তামিল সাংবাদিক ছিলেন,যিনি নেতাজী জার্মানি থেকে আসার পূর্বে ভারতীয় স্বাধীনতা লীগের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। আজাদ হিন্দ সরকার গঠনের সময় তিনি ছয়জন উপদেষ্টার একজন হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তিনি ডি. এম. খান সরকারের অপর একজন মুসলিম উপদেষ্টা ছিলেন। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে,তাঁরা দু’জনেই জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত পাঁচজন “ব্যক্তিগত শত্রু”-র অন্যতম ছিলেন।


আব্দুল হাবিব ইউসুফ মারফানি:আব্দুল হাবিব ইউসুফ মারফানি ছিলেন একজন ধনী গুজরাটি ব্যবসায়ী, যিনি রেঙ্গুনে বসতি স্থাপন করেছিলেন। নেতাজীর ভাষণ তাঁর মধ্যে গভীর জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগিয়ে তোলে। ১৯৪৪ সালের ৯ জুলাই পর্যন্ত তিনি নিয়মিতভাবে একসঙ্গে দুই থেকে তিন লাখ টাকা নগদ দান করতে থাকেন। একবার, নেতাজী যখন একটি জনসভায় অর্থ সাহায্যের আবেদন করেন, তখন মারফানি রূপার তৈরি একটি ট্রে হাতে এগিয়ে আসেন, যাতে গয়না, সম্পত্তির দলিল ও নগদ টাকা ছিল। সে সময় এগুলির আনুমানিক মূল্য ছিল এক কোটি টাকা। নিজের সমস্ত সম্পদ দানের পরে তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজের খাকি ইউনিফর্ম চেয়েছিলেন।

নেতাজী তাঁকে আজাদ হিন্দ সরকারের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান “তমঘা-ই-সেবক-ই-হিন্দ” প্রদান করেন এবং বলেন:
"কিছু লোক বলে হাবিব পাগল হয়ে গেছে। আমি একমত। আমি চাই, আপনারা প্রত্যেক ভারতীয় পাগল হয়ে যান। আমাদের দেশ ও মাতৃভূমির জন্য বিজয় এবং স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আমাদের এমন পুরুষ ও নারীরই প্রয়োজন।"


সৈনিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার মুহূর্তে নেতাজী

যুদ্ধ চলাকালীন, ৫০ জনেরও বেশি সৈনিককে আজাদ হিন্দ ফৌজের বীরত্বপূর্ণ পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়েছিল। এই সম্মাননাগুলি ছিল:তামঘা-ই-শরাফ-ই-জং, তামঘা-ই-বীর-ই-হিন্দ, তামঘা-ই-বাহাদুরি ,তামঘা-ই-শত্রু নাশ, এবং চেনাদ-ই-বাহাদুরি।এই পুরস্কারগুলোর অনেকগুলি মুসলিম সৈন্যদেরও প্রদান করেছিলেন নেতাজী নিজে।তামঘা-ই-শরাফ-ই-জং (Tamgha-e-Sharaf-e-Jang)
 কর্নেল এস. এ. মালিক
 মেজর শিকান্দর খান
 মেজর আবিদ হুসেইন
 ক্যাপ্টেন তাজ মহম্মদ
তামঘা-ই-বীর-ই-হিন্দ (Tamgha-e-Bir-e-Hind)
 লেফটেন্যান্ট আশারফি মণ্ডল
 লেফটেন্যান্ট ইনায়াত উল্লাহ
তামঘা-ই-বাহাদুরি (Tamgha-e-Bahaduri)
 হাবিলদার আহমেদ দিন
 হাবিলদার দিন মহম্মদ
 হাবিলদার হাকিম আলী
 হাবিলদার গোলাম হায়দার শাহ
তামঘা-ই-শত্রু নাশ (Tamgha-e-Shatru Nash)
হাবিলদার পীর মহম্মদ
হাবিলদার হাকিম আলী
নায়েক ফেইজ মহম্মদ
চিপাহী গোলাম রছুল
নায়েক ফেইজ বক্স
চেনাদ-ই-বাহাদুরি
হাবিলদার আহমদ-উদ-দিন
হাবিলদার মহম্মদ আঘর
হাবিলদার গুলাব শাহ
 
এই তালিকাটি সীমিত এবং এখনও বশির আহমেদ এবং মনোয়ার হুসেইন এর মতো ব্যক্তিদের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়নি, যারা আজাদ হিন্দ সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। আজিজ আহমেদ খান এবং ইনায়াত কিয়ানি, যারা আজাদ হিন্দ ফৌজের তিনটি রেজিমেন্টের দুটি কমান্ডার ছিলেন, নাজির আহমেদ এবং শেখ মহম্মদ—যিনি ভিয়েতনামে ইন্ডিয়া ইনডিপেন্ডেন্স লিগের এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব যারা নেতাজীর ওপর হামলার সময় নিহত হয়েছিলেন, তাদের নামও এই তালিকায় আসেনি। এই তালিকা অনেক দীর্ঘ। আমি অনুভব করি যে, আমার এই প্রবন্ধটি অবশ্যই অনেক মানুষকে আধুনিক ভারতের গঠনে মুসলিমদের অবদানের বিষয়ে অবগত করবে।