দৌলত রহমান, গুয়াহাটিঃ
প্রায় ৬০০ বছর ধরে অসমে শাসন করা আহোম সাম্রাজ্যের এক হারিয়ে যাওয়া রাজকুমারীর সন্ধান এখনো অব্যাহত রেখেছেন বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ, লেখক ও ঔপন্যাসিক ড. আবদুন নূর।
২০০৭ সালে ড. নূর তাঁর ‘বিচলিত সময়’ নামক উপন্যাসে মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র মুহাম্মদ আজম শাহর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে ঢাকায় ফিরে যাওয়া সেই রাজকুমারীর বিষয়ে বিশদভাবে তুলে ধরেন।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ড. নূর তাঁর অসম সফরে হারিয়ে যাওয়া সেই আহোম রাজকুমারীর প্রসঙ্গে সচেতনতা গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। তিনি আশ্চর্য প্রকাশ করে বলেন, এত সুন্দর ও বিশিষ্ট এক রাজকুমারীর জীবনের শেষ পর্ব নিয়ে আহোম ও মোগল উভয় ইতিহাসে কেন এই নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।
নিখোঁজ রাজকুমারী
‘আওয়াজ–দ্যা ভয়েস’-এর সঙ্গে এক আলাপচারিতায় ড. নূর বলেন, এই নিখোঁজ রাজকুমারী ছিলেন আহোম রাজা জয়ধ্বজ সিংহের (১৬৪৮–১৬৬৩) একমাত্র কন্যা—রমণী গাভরু।
ড. নূরের মতে, যেহেতু রাজা জয়ধ্বজ সিংহের কোনো পুত্র ছিল না, তাই তিনি নিজের কন্যা রমণী গাভরুকে রাজ্যের উত্তরাধিকারী বা শাসক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়ার জন্য রাজ্যাভিষেকের পরিকল্পনা করেছিলেন। এর অর্থ, জয়ধ্বজ সিংহের পর রমণী গাভরু আহোম সাম্রাজ্যের রাজা (রানী নয়, রাজাই) হতেন।
ড. নূর বলেন, "রাজা জয়ধ্বজ সিংহের এই সিদ্ধান্ত আহোম বংশের যুগ যুগ ধরে চলে আসা প্রথা ভঙ্গ করেছিল। কারণ, আহোমদের ঐতিহ্য অনুযায়ী কেবল পুত্রই রাজা বা উত্তরাধিকারী হিসেবে নিযুক্ত হতে পারত।"
ড. নূরের মতে, ১৬৫৯ সালে মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেব যখন মির জুমলাকে বঙ্গের সুবেদার হিসেবে নিয়োগ করেন, তখন তিনি ১৬৬২ সালে এক বিশাল সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে অসম আক্রমণ করেন। সেই সময় রমণী গাভরুর বয়স ছিল প্রায় ৯ বছর এবং আহোম রাজা জয়ধ্বজ সিংহ মুক্তিপণের বিনিময়ে তাকে মির জুমলার সেনার হাতে তুলে দিতে বাধ্য হন। রমণী গাভরু মির জুমলার সঙ্গে প্রথমে ঢাকায় এবং পরে দিল্লি যান। দিল্লিতে তিনি ১০ বছর অবস্থান করেন এবং পরে ঔরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র মুহাম্মদ আজম শাহের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং ‘রহমত বানু’ নামে পরিচিত হন।
আহোম রাজকন্যার বিবি পরীর সমাধি
১৬৭৮ সালে তার স্বামী আজম শাহকে মোগল প্রশাসনের আওতাধীন ঢাকার সুবেদার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলে, রহমত বানুও তার সঙ্গে ঢাকায় যান।ড. নূর বলেন, “মজার ব্যাপার হলো, আজম শাহের আরও দুইজন স্ত্রী ছিল। ঢাকায় সুবেদার পদে থাকার ১৫ মাস পর তিনি দিল্লিতে ফিরে যান। আজম শাহের অন্য দুই স্ত্রীও ঢাকায় এসেছিলেন এবং তার সঙ্গে দিল্লি ফিরে যান। আমি শুনেছি, যখন আজম শাহ ঢাকা ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন রমণী গাভরু গর্ভবতী ছিলেন। পরে তিনি ঢাকাতেই এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। আমার জানা অনুযায়ী, তিনি তার ছেলের জন্য একটি আহোম নাম রেখেছিলেন এবং আশা করেছিলেন, একদিন তার পুত্র আহোম সাম্রাজ্য শাসন করবে। এরপর রমণী গাভরুর জীবনের ইতিহাস একেবারেই নিঃশব্দ হয়ে যায়। আমি আজও এই আহোম রাজকুমারীর জীবনের পরবর্তী অধ্যায় অনুসন্ধানের চেষ্টা করে যাচ্ছি।”
উল্লেখযোগ্য যে, আসামের গোয়ালপাড়া জেলার এক পরিবারে বিবাহসূত্রে যুক্ত ড. নূর ২০০৫ সালের আগে বিখ্যাত অসমীয়া সাহিত্যিক প্রয়াত অতুলানন্দ গোস্বামীর কাছ থেকে পাওয়া একটি ছোট ইতিহাসবিষয়ক বই থেকেই রমণী গাভরু সম্পর্কে প্রথম জানতে পারেন।
শৈইস্তা খান নির্মিত এবং বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থিত ১৭শ শতকের অসমাপ্ত মোগল ভবন লালবাগ কেল্লা বহু দেশি-বিদেশী পর্যটককে আকর্ষণ করে। পর্যটকদের আকর্ষণের কারণ হলো এর প্রাচীরের ভিতরে থাকা একটি সমাধিস্থল, যা জনপ্রিয়ভাবে 'পরি বিবির কবর' নামে পরিচিত। এমনকি বাংলাদেশের অনেকেই বলেন যে, পরী বিবি হচ্ছেন শৈইস্তা খানের প্রিয় বড় মেয়ে,যিনি মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের পুত্র মুহাম্মদ আজম শাহের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। ১৬৮৪ সালে তার মৃত্যুর পর খান পরিবার ধ্বংসের মুখে পড়ে এবং দৃশ্যত দুর্গটির অধিক নির্মাণের পরিকল্পনা পরিত্যাগ করা হয়, এবং এর প্রাচীরের ভিতরে তার কন্যাকে সমাধিস্থ করা হয়।
১৯৫২ সালে 'গ্লিম্পস অব অল্ড ঢাকা' নামক গ্রন্থ রচনা করা বাংলাদেশি ইতিহাসবিদ সৈয়দ মহম্মদ টাইফুরে উল্লেখ করেছিলেন যে পরী বিবি আসলে ছিলেন রমণী গাভরু।টাইফুরে লিখেছেন, “সম্রাট ঔরঙ্গজেব রমণী গাভরুকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে উৎসাহিত করে ১৬৭৭ সালে এক লাখ আশি হাজার টাকার যৌতুকের বিনিময়ে রাজকুমার আজমের সঙ্গে বিবাহ দেন। প্রসবজনিত রোগে আক্রান্ত রাজকুমারী ঢাকায় বসবাস করতেন।” টাইফুরে আরো লিখেছেন, যেহেতু তিনি অসাধারণ সুন্দরী এবং রাজকুমারের অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন, তাই তাকে ভালোবেসে ‘বিবি পরী’ নামে অভিহিত করা হয়েছিল।
লেখক রাজকুমারীর উৎস সন্ধানে
ইতিহাসবিদ বেগম লুতফুন্নেছা হাবিবুল্লাহর বাংলা ভাষায় লিখিত ‘আহোম রাজকন্যার বিবি পরীর সমাধি’ শীর্ষক গবেষণাপত্রেও একই ধরনের তত্ত্ব পাওয়া যায়। তার গবেষণাপত্রটি আহোম ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে রচিত ছিল।
'বিচলিত সময়' উপন্যাসে ড. নূর বর্তমান বাংলাদেশ এবং আসামের বন্ধুত্বের একটি সুন্দর প্রতীক হিসেবে রহমত বানু বা রমণী গাভরুকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। "মোগল সেনাপতির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পরও রমণী গাভরু নিজের অসমীয়া পরিচয় বজায় রেখেছিলেন, পাশাপাশি এক মোগল সুবেদারের স্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছিলেন। তবে আমি একজন কল্পকাহিনী লেখক। আমার কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমি ইতিহাসবিদ নই। তবে রমণী গাভরুকে ইতিহাসের পৃষ্ঠায় ভুলে যাওয়া অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। আমি দৃঢ়ভাবে অনুভব করি যে বর্তমান ইতিহাসবিদদের উচিত আহোম সাম্রাজ্যের হারিয়ে যাওয়া এই রাজকুমারীকে পুনরায় আবিষ্কার করা।" ড. নূরে বলেছেন।