আধুনিক অসমীয়া গহনার পথপ্রদর্শক ওয়াহিদা রহমান

Story by  Munni Begum | Posted by  Sudip sharma chowdhury • 1 d ago
গহনা ডিজাইনার ওয়াহিদা রহমান
গহনা ডিজাইনার ওয়াহিদা রহমান
 
মুন্নী বেগম, গুয়াহাটি ঃ

পারম্পরিক অসমীয়া গহনা হলো অসমীয়া সংস্কৃতির এক গৌরব। এই গহনাগুলোর একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তবে দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, বহু পারম্পরিক অসমীয়া গহনা হারিয়ে যাওয়ার পথে ছিল। কারণ, অসমীয়া গহনা মূলত লাহা (আম্বার) ও পাতসোনার (স্বর্ণের পাত) দ্বারা নির্মিত হয়ে থাকে। ফলে এই গহনাগুলি একদিকে যেমন তুলনামূলক ভারী, অন্যদিকে এগুলোর পুনরায় বিক্রয়মূল্য (resale value) না থাকায় মানুষ এগুলোর ব্যবহার কমিয়ে দেয়। এর পরিবর্তে বাইরের রাজ্য থেকে আমদানি করা অন্যান্য ধরনের গহনার ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। এর ফলস্বরূপ, অসমীয়া গহনার জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে থাকে।

এই অবস্থায় অসমীয়া গহনাকে সংরক্ষণ করা এবং মানুষের মধ্যে এর জনপ্রিয়তা ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন অসমের প্রথম আধুনিক অসমীয়া গহনা ডিজাইনার ওয়াহিদা রহমান। ১৯৯৫ সালে তিনি হারিয়ে যেতে বসা অসমীয়া গহনাগুলিকে সংরক্ষণ করার পাশাপাশি গহনাগুলিতে আধুনিকতা যুক্ত করে নতুন রূপে মানুষের সামনে উপস্থাপন করার এক উদ্যোগ নেন।

" আওয়াজ দ্যা ভয়েস"-এর সঙ্গে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে প্রথম আধুনিক অসমীয়া গহনা ডিজাইনার ওয়াহিদা রহমান বলেন,"ছোটবেলা থেকেই আমি সাজসজ্জা এবং গহনার প্রতি অত্যন্ত আগ্রহী ছিলাম। স্কুলজীবনেই আমি অসমীয়া গহনার ডিজাইন করার কথা ভাবতে শুরু করি। উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করার পর আমি অসমীয়া গহনায় আধুনিকতার সংযোজনের কাজ শুরু করি। কিন্তু সেই সময় (১৯৮৮ সালে) অসমীয়া গহনার ব্যবহার কমে যাওয়ার কারণে অনেক গহনা প্রায় হারিয়ে যাচ্ছিল। যেহেতু আমি অসমীয়া গহনাকে সংরক্ষণ করার কথা ভাবছিলাম, তাই আমি গহনার সংগ্রহ শুরু করি।”
 
 
 
অসমীয়া গহনাগুলির নকশা খুঁজে পাওয়ার জন্য ওয়াহিদা সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চল ঘুরে দেখেন, পাশাপাশি তিনি দেশ-বিদেশেও ভ্রমণ শুরু করেন। বেশিরভাগ অসমীয়া গহনার নকশা তিনি অসমের মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজনের কাছ থেকে এবং কিছু কিছু আহোম ও অন্যান্য জনজাতির কাছ থেকে সংগ্রহ করেন। তিনি যখন এই ভ্রমণ শুরু করেন, তখন বুঝতে পারেন যে রাজপরিবারের মহিলারা  যেসব অসমীয়া গহনা পরতেন, সেগুলো সাধারণ মানুষের গহনার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল। তিনি যতটা সম্ভব গহনার নকশা সংগ্রহের চেষ্টা করেন।
ওয়াহিদা বলেন,"প্রথমে আমি নিজের গহনা বিক্রি করে মাত্র ৫ হাজার টাকায় আধুনিক অসমীয়া গহনা তৈরির কাজ শুরু করেছিলাম। আমি লা ও পাতসোনা ছেড়ে খাঁটি সোনা ও রূপার মাধ্যমে অসমীয়া গহনা তৈরি করা শুরু করি। কিন্তু তখন আমার এই কাজটি অসমীয়া সমাজের পক্ষ থেকে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। সমাজ আমাকে অসমীয়া গহনার অপমান করছে বলেই মন্তব্য করেছিল। তবুও আমি মনোযোগসহকারে আমার কাজ চালিয়ে গেছি।”

প্রথম তিন বছরে তিনি মারাত্মক আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হন। কারণ, এই সময়কালে তার কোনো গহনাই বিক্রি হয়নি। ফলে তিনি কারিগরদের ঠিকভাবে বেতন দিতে পারেননি। উপরন্তু, বহু কারিগর তাকে ঠকিয়েছিল।

তবে বর্তমানে তিনি আর্থিকভাবে যথেষ্ট স্বনির্ভর হয়েছেন এবং প্রায় ৩০ জন কর্মীকে কর্মসংস্থানের সুযোগ দিতে সক্ষম হয়েছেন। লকডাউনের সময় ব্যবসায় কিছুটা প্রভাব পড়েছিল, তবুও গহনার জন্য তাঁর কাছে ক্রেতার আগমন থেমে থাকেনি।
 

ওয়াহিদা রহমানের অসমীয়া গহনার  নকশা
 
ওয়াহিদা বলেন,"বর্তমানে আমার কাছে রাজপরিবারের অসমীয়া গহনার ৭৫টি নকশা রয়েছে এবং আমার নিজস্ব ডিজাইন করা গহনার সংখ্যা ৪০০ থেকে ৫০০-রও বেশি। আমার প্রথম সৃষ্টি ছিল 'অংকুর থেকে ফুটে উঠা''। পরে আমি মেঘালয়, চেরাপুঞ্জি, , কপৌফুল, জাকৈ, খালৈ, তুলাধান, ধানের মুঠি, কলারফুল, কলারপাতা, কলাগাছ ছাড়াও লোকাপার, থুরীয়া, কৰ্ণসিংহ, জাংফাই, ডুগডুগি, মটর মণি, হরতকী, মণি, কিংখাপ ইত্যাদি নানা আকারে গহনার ডিজাইন তৈরি করেছি। আমি অসমের প্রতিটি জাতি ও জনজাতির পোশাক-আশাক ও সংস্কৃতিকে ভিত্তি করে গহনার নকশা তৈরি করেছি। বর্তমানে আমার ফিউশন ডিজাইনের গহনাগুলি অসমের গণ্ডি পেরিয়ে দেশ ও বিদেশের বহু মানুষের আগ্রহ ও ভালোবাসা অর্জন করেছে।”
 
গুয়াহাটির বাসিন্দা ওয়াহিদা রহমান দুঃখ প্রকাশ করে বলেন,"একটি বিষয় আমাকে খুব কষ্ট দেয়—আজকাল অসমীয়া গহনার নামে বাজারে অনেক নকল গহনা পাওয়া যাচ্ছে। কিছু লোক নিজেদের স্বার্থের জন্য অসমীয়া গহনার প্রকৃত রূপ বিকৃত করে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে এবং মানুষও সেগুলি আগ্রহ নিয়ে কিনে নিচ্ছে। এটি অসমীয়া গহনাক্ষেত্রের জন্য এক বড় হুমকি।” সবশেষে বলা যায়, ওয়াহিদা রহমানকে আমরা একজন সফল অসমীয়া মহিলা উদ্যোক্তা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারি।


ওয়াহিদা বলেন,"প্রত্যেকটি মেয়েরই আর্থিকভাবে স্বনির্ভর হওয়া উচিত। আজ আমরা নিজেদের আধুনিক বলে পরিচয় দিলেও, এখনো বহু পুরনো মানসিকতার দাস হয়ে রয়েছি। আজও একজন মেয়েকে, ছেলেদের তুলনায়, প্রায় সব ক্ষেত্রেই অনেক বেশি বাধার সম্মুখীন হতে হয়। একজন মহিলা হিসেবে আমাকেও গহনা ডিজাইনের ক্ষেত্রে বহু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে।আমার এগিয়ে যাওয়ার পথে আমাকে উৎসাহ দেওয়ার মতো কেউ ছিল না।তবুও, আমি আজ খুবই খুশি যে আমি সব বাধা ও সংগ্রাম একাই  মোকাবিলা করে সফল হতে পেরেছি।"