হিদায়াত কমান্ডো: পাঞ্জাবের বন্যায় মানবতার এক নতুন অধ্যায় রচনা করেছে

Story by  atv | Posted by  Sudip sharma chowdhury • 2 d ago
হিদায়াত কমান্ডো: পাঞ্জাবের বন্যায় মানবতার এক নতুন অধ্যায়
হিদায়াত কমান্ডো: পাঞ্জাবের বন্যায় মানবতার এক নতুন অধ্যায়
ইউনুস আলভি / নূহ,হরিয়ানা

নীতি আয়োগের রিপোর্টে দেশের সবচেয়ে পশ্চাৎপদ জেলাগুলোর মধ্যে একটি হরিয়ানার নূহ (মেওয়াত) জেলা আজ মানবতার এক নতুন সংজ্ঞা স্থাপন করছে। এখানকার মানুষ, বিশেষ করে ‘হিদায়াত কমান্ডো’ নামে পরিচিত প্রাক্তন সেনাকর্মী হিদায়াত খান, পাঞ্জাব ও হিমাচল প্রদেশের বন্যাদুর্গতদের সহায়তায় প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এটি শুধু একটি ত্রাণ কার্যক্রম নয়, বরং এমন একটি মানবিক দৃষ্টান্ত, যেখানে জাত, ধর্ম ও ভৌগোলিক সীমারেখা গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে।

হিদায়াত খান, যিনি ৩১ জুলাই ২০২৩-এ কাশ্মীরে কমান্ডোর পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন, তিনি সেনা জীবন শেষ হওয়ার পরও দেশ ও সমাজের সেবার পথ ছাড়েননি। তাঁর বিশ্বাস, একজন সৈনিকের কর্তব্য শুধুমাত্র সীমান্তে দেশের সুরক্ষা দেওয়া নয়, বরং সমাজের সবচেয়ে দুর্বল মানুষের কাছেও সাহায্য পৌঁছে দেওয়া।
 

সেবার সংকল্প: পোশাক থেকে সমাজ পর্যন্ত যাত্রা


হিদায়াত খানের সমাজসেবামূলক কার্যক্রম তাঁর অবসর গ্রহণের আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল। ২০২২ সালের ৬ জানুয়ারি, তিনি নূহ-এর গান্ধী পার্ক থেকে "নেশামুক্ত মেওয়াত অভিযান" শুরু করেন, যেটি জেলা প্রশাসনের পূর্ণ সমর্থন পায়। তাঁর বিশ্বাস, যদি মেওয়াতের যুবসমাজকে মাদকের হাত থেকে দূরে রাখা যায়,তবেই এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ পরিবর্তন সম্ভব।

তাঁর অবসর গ্রহণের দিনেই মেওয়াত হিংসার কবলে পড়ে এবং গোটা জেলা কেঁপে ওঠে। কারফিউ এবং উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশে,শহীদ হাসান মেওয়াতি মেডিকেল কলেজের রোগীরা খাবার ও পানীয়ের চরম সংকটে পড়েন। তখন হিদায়াত কমান্ডো দ্রুত কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

 
নিজের গ্রাম চাঁদেনি-র মানুষের সহযোগিতায় হিদায়াত খান দশ দিন ধরে হাসপাতালের রোগীদের বিনামূল্যে খাবার সরবরাহ করেন। এই কাজে গ্রামের প্রত্যেকটি ঘর অংশগ্রহণ করে, যা প্রমাণ করে—একতা থাকলে যেকোনো সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব।

এই সময়েই, অরাবল্লি পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরত দরিদ্র পরিবারগুলোর বাড়িঘর ভেঙে ফেলা হয়। তারা বাধ্য হয়ে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করতে শুরু করে। হিদায়াত কমান্ডো তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে এই পরিবারগুলোর জন্য খাবার, ত্রিপল এবং প্রাথমিক প্রয়োজনীয়তা জোগাড় করে দেন।
 

দরিদ্র কন্যাদের জন্য আশ্রয়: 'বেটি বচাও'-এর এক অনন্য উদ্যোগ


হিদায়াত কমান্ডো মেওয়াতে দরিদ্র ও অসহায় পরিবারের যুবতী কন্যাদের বিয়ে নিয়ে বিদ্যমান সমস্যাটি গভীরভাবে উপলব্ধি করেন। তিনি তাঁর সামাজিক সহযোগীদের নিয়ে একটি দল গঠন করেন, যারা ঘরে ঘরে গিয়ে বাস্তব পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এবং তারপর কোনও প্রচার ছাড়াই বিয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করেন।

এই মানবিক উদ্যোগের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত প্রায় ১১৫টি কন্যার বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। এটি শুধুমাত্র একটি পরিসংখ্যান নয়, বরং ১১৫টি পরিবারের আশা ও মর্যাদার গল্প।
 

শিক্ষা ও যুবসমাজের ভবিষ্যৎ: এক লক্ষ বইয়ের গ্রন্থাগার


হিদায়াত খানের বিশ্বাস, যুবসমাজের ভবিষ্যৎকে গড়ে তুলতে না পারলে সমাজ কখনোই এগোতে পারে না। এই চিন্তাধারা থেকেই তিনি যুবকদের জন্য দুটি বড় রক্তদান শিবিরের আয়োজন করেন এবং CET, HTET, CTET ও SSC-র মতো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য বিনামূল্যে কোচিং সেন্টার শুরু করেন।

বর্তমানে, নূহ জেলায় একটি বিশাল গ্রন্থাগার নির্মাণের কাজ চলছে, যেখানে এক লক্ষেরও বেশি বই রাখার লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। এই গ্রন্থাগার শুধু জ্ঞানের ভাণ্ডারই হবে না, বরং শিক্ষার্থীদের জন্য একটি দৃঢ় মঞ্চ হিসেবেও কাজ করবে, যেখানে তারা স্বপ্ন দেখতে ও বাস্তবায়িত করতে পারবে।
 

পঞ্জাবের বন্যায় মেওয়াতের মানবতা


সম্প্রতি পঞ্জাব, হিমাচল প্রদেশ এবং জম্মু-কাশ্মীরে সংঘটিত বিধ্বংসী বন্যা হাজার হাজার পরিবারকে গৃহহীন করে তোলে। এই কঠিন সময়ে, হিদায়াত কমান্ডো মানবতাকেই সর্বোচ্চ ধর্ম মনে করে তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে বন্যাকবলিত অঞ্চলগুলোর পরিদর্শন করেন।

তিনি কাপূরথলা, তরণ তারণ, ফিরোজপুর, ফাজিলকা এবং গুরদাসপুর জেলার মতো ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলিতে পৌঁছান এবং গুরদোয়ারা কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে বৈঠক করে ত্রাণ বিতরণের কৌশল নিয়ে আলোচনা করেন।

তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে, মেওয়াত থেকে মানবতার এক অসাধারণ তরঙ্গ উঠে আসে। ৩ সেপ্টেম্বর, ত্রাণসামগ্রী ভর্তি ৬০টি গাড়ি রওনা হয় এবং ৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০০টি গাড়িতে। মেওয়াতের মসজিদ ও মাদ্রাসাগুলোর মাধ্যমে মানুষের কাছে সাহায্যের আবেদন জানানো হয়।


সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা: বয়স্ক মায়েদের সোনাদান


সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় ছিল—অনেক বৃদ্ধা নারী শুধু তাঁদের জমানো নগদই নয়, বরং তাঁদের সঞ্চিত গহনাও বন্যার্তদের সাহায্যে দান করে দেন। এটি প্রমাণ করে যে মেওয়াতের মানুষের হৃদয়ে মানবতার অনুভূতি কতটা গভীরভাবে প্রোথিত।

লুধিয়ানার এক বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং জমিয়ত উলামা-ই-হিন্দ পাঞ্জাব শাখার নায়েব সদর নওশাদ আলমের বৃহৎ কারখানায়, জমিয়ত উলামা-ই-হিন্দ মেওয়াত শাখার ব্যানারে একটি ত্রাণ শিবির স্থাপন করা হয়। সেখান থেকে চারটি রাজ্যের মহাসচিব, মাওলানা ইয়াহিয়া করিমি ও মুফতি সলিম কাসেমির নেতৃত্বে, পাঞ্জাব, হিমাচল ও জম্মু-কাশ্মীরের বন্যাকবলিত এলাকায় ত্রাণসামগ্রী পাঠানো হচ্ছে।
 

মাদকবিরোধী হিদায়াত কমান্ডোর অভিযান

হিদায়াত খান বলেন,"প্রকৃতির আঘাত থেকে কেউই রক্ষা পায় না। যখন দেশের কোনো প্রান্তে বিপদ আসে, তখন দেখা যায় শিখ সম্প্রদায় সবসময় মানবসেবায় সবার আগে দাঁড়িয়ে থাকে। আজ যখন পাঞ্জাবের মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়ছে, তখন মানবতার দাবি হল—আমরা সকলে একসাথে এগিয়ে এসে তাদের সাহায্য করি।"
 

 
হিদায়াত খানের গল্প শুধুমাত্র মেওয়াতের জন্য নয়, বরং গোটা দেশের জন্য এক অনুপ্রেরণা।এটি এক সৈনিকের গল্প, যিনি পোশাক ছাড়ার পরেও সেবার পথ ছাড়েননি।নেশামুক্ত সমাজ, শিক্ষা, সামাজিক ন্যায় এবং ত্রাণকাজ—প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁর সক্রিয়তা প্রমাণ করে যে, যদি সংকল্প দৃঢ় হয়, তবে পরিবর্তন সম্ভব।