অনিকা মহেশ্বরী / নতুন দিল্লি
বলিউডের সুপারহিট ছবি ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে’-তে শাহরুখ খান তামার তৈরি একটি ঘণ্টার জন্যই তার প্রেমিকাকে পেয়েছিলেন। কিন্তু এই তামার ঘণ্টাটি এখন আর শুধু পশুপাখির গলায় ঝোলানো একটি ঘণ্টা হিসেবে নেই, এটি মানুষের হৃদয়ের স্প ন্দনেপরিণত হয়েছে। কারণ, বর্তমানে মানুষ এই ঘণ্টা দিয়ে ঘর সাজিয়ে তুলছে। বিশেষ করে এই তামার ঘণ্টাগুলোর পেছনে মূল কারণ হলো এদের বিশুদ্ধ শব্দ, ইতিবাচক শক্তি এবং শান্তির বার্তা।
৩৭তম আন্তর্জাতিক সুরজকুন্ড মেলায় এমন একজন শিল্পীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, যিনি দ্বাদশ শ্রেণি থেকেই তার বাবা নূর মোহাম্মদের কাছ থেকে তামার ঘণ্টা তৈরি করার কাজ শিখেছিলেন। তিনি শুধু ঘণ্টা তৈরি করাই নয়, এর শব্দ এবং তার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও গভীর জ্ঞান অর্জন করেছেন।
‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে’-তে তামার ঘণ্টা হাতে শাহরুখখান
‘গুজরাটিরা যেমনই হোক না কেন, সে সবসময় একজন ব্যবসায়ী হয়’—গুজরাটের এই বিখ্যাত কথাটিকে সত্য প্রমাণ করে শিল্পী আছগর লোহার আজ শুধু দেশে নয়, বিদেশেও নিজের শিল্পকলা প্রদর্শন করছেন। তিনি লন্ডন ও সিঙ্গাপুরেও তামার ঘণ্টা প্রদর্শন করে সুনাম অর্জন করেছেন।
আছগর লোহার ‘আওয়াজ—দ্য ভয়েস’কে জানান যে, একটি তামার ঘণ্টা তৈরি করতে অনেক ধৈর্যের প্রয়োজন হয়। তিনি বিভিন্ন নকশা ও শব্দের ওপর নিরন্তর কাজ করে চলেছেন। সাধারণত তামার ঘণ্টাগুলি যেখানেই থাকুক না কেন, এদের ধ্বনি প্রায় একই ধরনের হয়—এটাই এই ঘণ্টাগুলোর বিশেষত্ব। কিন্তু আছগর লোহার তৈরি ঘণ্টাগুলিতে ‘ওম’,‘সরগম’ ইত্যাদি ধ্বনিও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
প্রায় ২০০ বছরের পুরনো পৈতৃক শিল্পকলা শেখার পর আছগর লোহার এখন অনেক আগ্রহীকে এই শিল্প শেখাতে শুরু করেছেন। তিনি NIT, NIFT-এর মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও যুক্ত, যেখানে তিনি প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন।
তামার ঘণ্টার একটি দোকান
আছগর লোহার বলেন, তিনি এমন একটি গ্রামের বাসিন্দা, যেখানে তাঁর মুসলিম পরিবারটি হিন্দু ভাইবোনদের সঙ্গে সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করে আসছে। গুজরাটের কচ্ছ জেলার জুরা গ্রামে বসবাসকারী আছগর লোহার বর্তমানে ২৫ থেকে ৩০টি পরিবারের জীবিকার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। তাঁর কারখানায় কর্মরত শিল্পীরা তামার ঘণ্টা তৈরির কাজে নিয়োজিত।
আছগর লোহার তাঁর কারখানায় কর্মরত শিল্পীদের ভালো পারিশ্রমিক দিয়ে থাকেন, যার ফলে ১৫০ থেকে ২০০ জন মানুষের জীবিকা সুনিশ্চিত হয়েছে। ‘আওয়াজ—দ্য ভয়েস’-এর মাধ্যমে তিনি সরকারকে অনুরোধ করেছেন এই প্রাচীন শিল্পকলার প্রসারে এগিয়ে আসতে। প্রচণ্ড উত্তাপের আগুনে পিটিয়ে এবং অসীম ধৈর্যের সঙ্গে কাজ করে যে নিখুঁত একটি ঘণ্টা তৈরি হয়, তারজন্য সত্যিকার অর্থে কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজন হয়।
আছগর লোহার এখন এতটাই দক্ষ হয়ে উঠেছেন যে, তিনি তামার চিটে আগুনে পিটিয়ে মানুষের মুখের অবয়বও তৈরি করতে পারেন। ডিজিটাল যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিনি এখন কাস্টমাইজড প্যাটার্ন তৈরির দিকেও নজর দিচ্ছেন, যেখানে 'ওম', সূর্য, বড় ঘণ্টা, ছোট ঘণ্টা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকছে।
তামার ঘণ্টার প্রদর্শনী
আছগরের বাবা নূর মোহাম্মদ তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে তামার ঘণ্টা তৈরির এই কৌশল শিখেছিলেন, যা তিনি এখনও মানুষকে শেখাচ্ছেন। এই শিল্পকলার জ্ঞান অর্জন করতে ইচ্ছুক অনেকে দূর-দূরান্ত থেকে তাঁর কাছে প্রশিক্ষণ নিতে আসেন। তিনি বলেন, আজকের ব্যস্ত জীবনযাত্রার মধ্যে তামার ঘণ্টা ব্যবহার করে একটি শান্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা সম্ভব এবং এর মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ শান্তিও খুঁজে পাওয়া যায়।
ধ্যানকেন্দ্রে তামার ঘণ্টার সাহায্যে মালিশ করার পরে এমন এক শব্দ শোনা যায়, যা মানুষের মনে এক বিশেষ প্রশান্তি নিয়ে আসে। এই শান্ত ও ধ্যানমগ্ন শব্দটি তৈরি করা আমাদের জন্য এক চ্যালেঞ্জিং কাজ, যার জন্য আমরা দিনরাত পরিশ্রম করি। আর এই ক্ষেত্রের আমাদের শিল্পীরা প্রত্যেকেই এক একজন বিশেষজ্ঞ।
আছগর লোহার বলেন, প্রতিটি ঘণ্টার শব্দ ‘একল নামের’ বাদ্যযন্ত্র দ্বারা নির্ধারিত হয়। এটি তিনটি উপাদানের উপর নির্ভর করে—ধ্বনির গুণমান, অনুরণন, এবং শব্দ উৎপাদনের ধরন। বহু শতাব্দী আগে সিন্ধু অঞ্চল থেকে কচ্ছ অঞ্চলে যাত্রা করা গরু-মহিষের গলায় বাঁধা ঘণ্টার শব্দও মানুষ শুনেছে। তামা দিয়ে নির্মিত ঘণ্টা শিল্পের প্রসারক আছগর লোহার এই শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অক্লান্তভাবে কাজ করে চলেছেন। তাঁর এই শিল্প শুধু সুন্দর এবং মনোমুগ্ধকরই নয়, এটি শান্তি এবং একাগ্রতাও নিয়ে আসে।