আওয়াজ দ্য ভয়েস , চেন্নাই ঃ
যখন দুনিয়া ঝকঝকে আলো আর প্রতিযোগিতায় ডুবে রয়েছে, তখন এমন একটি নাম উঠে এসেছে, যিনি শুধু অন্ধকারে নিজের পথ খুঁজে পেয়েছেন তাই নয়, বরং অন্যদের জন্যও পথ প্রদর্শক হয়ে উঠেছেন তিনি হলেন ডঃ 'ইনস্পায়ারিং' ইলঙ্গো। জন্মগতভাবে দৃষ্টিহীন হওয়া সত্ত্বেও, তিনি প্রমাণ করেছেন যে ইতিহাস চোখ দিয়ে নয়, দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে তৈরি হয়।
১৯৭২ সালে চেন্নাইতে জন্মগ্রহণ করেন ডঃ ইলঙ্গো। তিনি জন্ম থেকেই সম্পূর্ণরূপে দৃষ্টিহীন। সাধারণত এমন অবস্থায় পরিবার ও সমাজ আশা ছেড়ে দেয়, কিন্তু ইলঙ্গো সেই অন্ধকারকেই নিজের অনুপ্রেরণা হিসাবে গ্রহন করেন। তিনি শুধু জীবনকে বাঁচাননি, বরং তাকে এক মহৎ উদ্দেশ্যর ও দিকে নিয়ে গিয়েছেন ।
ইলঙ্গোর বহুমাত্রিক প্রতিভা শৈশব থেকেই ফুটে উঠতে শুরু করে। তাঁর কণ্ঠে এমন এক জাদু ছিল, যা তাঁকে বিজ্ঞাপন, ডকুমেন্টারি এবং শর্ট ফিল্মের জগতে জনপ্রিয় করে তোলে।
ডঃ ইলঙ্গো সংবর্ধনা প্রদান অনুষ্ঠানে
তিনি শুধু একজন খ্যাতনামা ভয়েস আর্টিস্টই নন, বরং ২০১২ সালে ৪২ পর্বের একটি মিউজিক্যাল টক শোর হোস্ট হিসেবেও পরিচিত হয়ে ওঠেন। তাঁর শো এবং বক্তৃতার মূল বিষয়বস্ততে থাকে আবেগ নিয়ন্ত্রণ, ভাষার শক্তি এবং জীবনযাপনের শিল্প।
শিক্ষাক্ষেত্রেও তিনি উৎকর্ষতার এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছেন। মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা শিক্ষায় (এম.ফিল.) কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। এর আগে চেন্নাইয়ের লোয়োলা কলেজ থেকে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রথম শ্রেণিতে লাভ করেন এবং পাবলিক স্পিকিংয়ে স্বর্ণপদক অর্জন করেন।
১২ মে, ২০১৯ তারিখে ইউনিভার্সাল তামিল ইউনিভার্সিটি, পুদুচেরি ডঃ ইলঙ্গোকে তাঁর অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য সম্মানসূচক ডক্টরেট প্রদান করেন। এরপর তিনি এমন এক ক্ষেত্রে ইতিহাস সৃষ্টি করেন, যেখানে কেউ তাঁর কল্পনাও করতে পারেনি।
স্কুবা ডাইভিং এবং প্যারাগ্লাইডিং-এ বিশ্ব রেকর্ড তৈরি করে্ন । তিনি বিশ্বের প্রথম দৃষ্টিহীন ব্যক্তি হয়ে যিনি এই দুইটি অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস-এ পারদর্শিতা অর্জন করেছেন। এটি শুধুমাত্র একটি রেকর্ড ছিল না, বরং দৃষ্টিহীনতার সংজ্ঞাকেই চ্যালেঞ্জ জানানোর এক বিপ্লব ছিল।
ডঃ ইলঙ্গো বর্তমানে Ace Panacea Life Skills Pvt. Ltd.-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং Vision Inspiring Ilango Foundation-এর প্রতিষ্ঠাতা তিনি। ডঃ ইলঙ্গো NTC গ্রুপ-এর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর, একজন অনুপ্রেরণাদায়ক বক্তা, লেখক, পেশাদার গায়ক, ইমোশন ম্যানেজমেন্ট কনসালটেন্ট এবং একজন জনপ্রিয় মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।
তিনি ৩৫০০র অধিক গান বিভিন্ন ভাষায় গেয়েছেন। সংগীতকে তিনি শুধু একটি শিল্প নয়, বরং “Musiration”— সংগীত এবং প্রেরণার সংমিশ্রণ বলে মনে করেন। তাঁর বিশ্বাস, “সঙ্গীত সেখানে পৌঁছে যায়, যেখানে শব্দ হার মানে।”
কোভিড-১৯ মহামারির সময়, যখন পুরো বিশ্ব শারীরিক রোগের সঙ্গে লড়াই করছিল, তখন ডঃ ইলঙ্গো হাজার হাজার মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষের জন্য বিনামূল্যে কাউন্সেলিং প্রদান করেন। তিনি বলেন, “মানসিক মহামারিও ভাইরাল মহামারির মতোই ভয়ানক ছিল।”
ডঃ ইলঙ্গোর তামিল বই ‘Jeyippadhu Nijam’ (অর্থাৎ “জেতা সম্ভব”) সেই হাজার হাজার মানুষের জন্য আশার আলো হয়ে উঠেছে, যারা হতাশা বা আত্মহত্যার চিন্তার সঙ্গে লড়াই করছেন। এই বইটি আজ অনেকের জীবনে এক পথপ্রদর্শকের মতো কাজ করছে।
এই চিন্তাধারাকেই আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে তিনি তাঁর স্ত্রী শ্রীলতা-র সঙ্গে মিলে Vision Inspiring Ilango Foundation-এর প্রতিষ্ঠা করেন। এই ফাউন্ডেশন বিশেষভাবে যুবসমাজের মধ্যে আবেগগত সচেতনতা, আত্মবিশ্বাস এবং দায়িত্ববোধ গড়ে তোলার জন্য কাজ করে।
পরিবার: শক্তির আসল শিকড়
ডঃ ইলঙ্গো তাঁর প্রতিটি সংগ্রাম এবং সাফল্যের কৃতিত্ব নিজের পরিবারকে দেন। তাঁর স্ত্রী শ্রীলতা শুধু তাঁর জীবনসঙ্গিনী নন, বরং তাঁর মিশনের সহযাত্রীও। তাঁদের পুত্র এস.আরবণ বেট্রি ইলঙ্গো একজন উদীয়মান কিশোর সংগীতশিল্পী এবং তাঁর বাবার মতোই শিল্পকেই জীবনের পথ হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
ইলঙ্গো বলেন, “আমার চোখ নেই, কিন্তু আমার দৃষ্টিভঙ্গি আছে। আমি পৃথিবীকে অন্যদের মতো দেখি না, কিন্তু আমি এটিকে তেমনই গড়ে তুলতে চাই, যেমন আমি তা কল্পনা করি…”
তাঁর কাছে সাফল্য পুরস্কারে নয়, বরং সেই জীবনগুলোর মধ্যে নিহিত, যেগুলোর মধ্যে তিনি নতুন আশার আলো জ্বালাতে পেরেছেন। আবেগগত পরামর্শ হোক, ভাষা শিক্ষা, সংগীত বা অ্যাডভেঞ্চার ইলঙ্গো প্রতিটি ক্ষেত্রেই শেখাচ্ছেন যে ভয় একটি মানসিকতা, আর সাহস এক ধরনের পছন্দ।
তিনি হেসে বলেন, “আকাশও কোনো সীমা নয় ওটা তো কেবল শুরু মাত্র।”