২০২৪ সালের ক্রিসমাসে ব্যাসিলিকা অব দ্য হোলি রোজারি (ব্যান্ডেল চার্চ) -এর একটি দৃশ্য
অপর্ণা দাস
ভারত কেবল নানা ধর্মের দেশ নয়, ভারত আসলে নানা বিশ্বাসের সহাবস্থানের এক জীবন্ত অনুভূতি। এখানে পরমাত্মার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কোনো একটি নির্দিষ্ট আচার, ধর্ম বা উৎসবে সীমাবদ্ধ নয়।ভক্তি ও শান্তি যেখানে হৃদয় খুঁজে পায়, সেখানেই পরমাত্মার উপস্থিতি অনুভূত হয়। এই দেশের মাটিতেই মন্দির, মসজিদ ও গির্জা একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে মানুষের অন্তরের একতার কথা বলে। ঠিক সেই ভারতের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও মানবিক ঐক্যের এক স্পষ্ট ছবি আমি ফুটে উঠতে দেখেছিলাম ক্রিসমাস উৎসবের সময় পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহাসিক ব্যান্ডেল চার্চে, যেখানে উৎসবের আলো শুধু যিশুর জন্মদিন উদ্যাপন করে না, বরং মানুষের বিশ্বাসের সীমানাকেও অতিক্রম করে।
হুগলি জেলার ব্যান্ডেলে অবস্থিত ব্যান্ডেল চার্চ, যার আসল নাম ব্যাসিলিকা অব দ্য হোলি রোজারি, ভারতের অন্যতম প্রাচীন খ্রিস্টান উপাসনালয়। ১৫৯৯ সালে পর্তুগিজ মিশনারিদের উদ্যোগে এই চার্চ প্রতিষ্ঠিত হয়, যখন হুগলি ছিল আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। ইতিহাসের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের সাক্ষী এই চার্চ একসময় মুঘল আক্রমণে ধ্বংস হয়েছিল, পরে ১৬৬০ সালে পুনর্নির্মিত হয়। চার্চের দেওয়ালে খোদাই করা “In Peril, Remember” আজও মানুষের বিশ্বাস, আশা ও পুনর্জাগরণের কথা নীরবে স্মরণ করিয়ে দেয়।
ব্যান্ডেল চার্চের বাগানের কিছু ভাস্কর্য শিল্প
২০২৪ সালের ক্রিসমাসে প্রথমবার ব্যান্ডেল চার্চে পা রাখার অভিজ্ঞতা ছিল একেবারেই আলাদা। চার্চ চত্বরে মানুষের ভিড় থাকলেও সেই ভিড় কোনো একটি ধর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। খ্রিস্টানদের পাশাপাশি হিন্দু, মুসলিম, শিখ, সব ধর্মের মানুষ সেখানে সমান শ্রদ্ধায় উপস্থিত। কেউ মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রার্থনায় মগ্ন, কেউ নীরবে দাঁড়িয়ে সেই প্রশান্ত পরিবেশটুকু অনুভব করছে। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল শান্তির এক অদ্ভুত অনুভূতি, যা শব্দ ছাড়াই হৃদয়ে পৌঁছে যাচ্ছিল।
ক্রিসমাসে যিশুর সামনে মোমবাতি জ্বালানো একটি পরিচিত রীতি হলেও, সেদিন এক দৃশ্য মনে গভীর দাগ কেটে দেয়। এক ব্যক্তি যিশুর সামনে ধূপকাঠি জ্বালাচ্ছিলেন, যা সাধারণত হিন্দু উপাসনায় ব্যবহৃত হয়। তাঁর এই ছোট্ট অথচ অর্থবহ কাজটি যেন বলে দিল, এই দেশে ঈশ্বরের রূপ আলাদা হলেও বিশ্বাসের মূল সুর এক। তাঁর চোখে যিশু আলাদা কোনো ধর্মের প্রতীক নন, বরং সেই পরম সত্তা, যাকে তিনি নিজের পরিচিত আচারেই শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।
ক্রিসমাসে হুগলির ব্যান্ডেল চার্চের একটি দৃশ্য
চার্চ প্রাঙ্গণে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের উপস্থিতিও ছিল চোখে পড়ার মতো। বোরখা পরা মুসলিম নারীদের দেখা গেছে নীরবে গির্জায় প্রবেশ করতে, যিশুর সামনে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করতে এবং সেই শান্ত পরিবেশ উপভোগ করতে। সেখানে কেউ কারও ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন করেনি, কেউ কৌতূহলের দৃষ্টিতে তাকায়নি। সেই মুহূর্তে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, পরমাত্মার সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক কোনো ধর্মীয় সীমারেখায় আবদ্ধ নয়; ভক্তি ও শান্তি যেখানে অনুভূত হয়, সেখানেই ঈশ্বরের আসন।
এই সম্প্রীতির আবহেই কথা হয় দর্শনার্থী ডা. রত্নময় সাহার সঙ্গে। তিনি জানান, প্রতি বছরই ক্রিসমাসের সময় তিনি ব্যান্ডেল চার্চে আসেন, কারণ এখানে তিনি এক আলাদা শান্তি অনুভব করেন। ডা. সাহার স্ত্রী অঞ্জনা সাহা বলেন, “আমরা আজ আমাদের মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে এসেছি, কারণ ওকে ভারতের আসল সৌন্দর্যটা দেখাতে চাই। আমরা চাই ও ছোট থেকেই শিখুক, সব ধর্মকে সম্মান করতে হয়, সব উৎসবকে আপন করে নিতে হয়।”
ব্যান্ডেল চার্চের ভেতরের দৃশ্য
তিনি আরও জানান, তাঁদের বাড়িতে ক্রিসমাস এলেই বড়দিনের আনন্দে ক্রিসমাস ট্রি সাজানো হয়, আলো জ্বলে ওঠে উৎসবের খুশিতে। ধর্মের ভেদাভেদ নয়, বরং উৎসবের আনন্দ ভাগ করে নেওয়াই তাঁদের কাছে শিক্ষার মূল কথা। তাঁদের কথায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে, ভারতের ঐক্য কোনো স্লোগান নয়, এটি পরিবারে পরিবারে চর্চা হওয়া এক জীবন্ত সংস্কৃতি।
ক্রিসমাসের আলোয় সেদিন ব্যান্ডেল চার্চ শুধু যিশুর জন্মোৎসবের সাক্ষী ছিল না, বরং ভারতের বহুত্ববাদী আত্মার এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছিল। শতাব্দী প্রাচীন এই চার্চ যেন নিঃশব্দে মনে করিয়ে দিয়েছে, বিশ্বাসের পথ আলাদা হতে পারে, আচার ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু মানুষের হৃদয় যেখানে এক হয়ে যায়, সেখানেই ভারতের প্রকৃত পরিচয়।