গভীর অরণ্যে বাঘের সন্ধানে বিরল এই মানুষটি

Story by  atv | Posted by  Sudip sharma chowdhury • 8 d ago
ফিরোজ আহমেদ কাজের মধ্যে
ফিরোজ আহমেদ কাজের মধ্যে
 
দৌলত রহমান,গুয়াহাটিঃ 

তিনি বাঘের সঙ্গে থাকতে ভালোবাসেন। শুনে অবাক লাগলেও কথাটি অত্যুক্তি নয়। গভীর অরণ্যের মধ্যে বাঘ খুঁজে বেড়ানো এবং তাদের ক্যামেরায় বন্দী করাই যেন তার নেশা।এই বিপজ্জনক কাজের পেছনে থাকা ব্যক্তি হলেন ফিরোজ আহমেদ। উত্তর-পূর্ব ভারতের বন্যপ্রাণী জীববিজ্ঞানী ফিরোজ ভারতের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বাঘ বিশেষজ্ঞদের একজন।
 
২০১০ সালে কাজিরাঙা জাতীয় উদ্যানে জলে বিশ্রাম নেওয়া একটি প্রাপ্তবয়স্ক বাঘকে তিনি ক্যামেরা বন্ধী করেন ।সেই দৃশ্য ফিরোজ তার ক্যামেরায় বন্দী করার পর তিনি সারা দেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। বাঘের সেই ছবি ক্যামেরায় বন্ধী করার পর ফিরোজ আবিষ্কার করেন যে ভারতের মধ্যে প্রতি ১০০ বর্গ কিলোমিটারে বাঘের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি ছিল কাজিরাঙায়।
ফিরোজ অবশ্য স্বীকার করেন যে এই কঠিন কাজটি কাজিরাঙার বহু অভিজ্ঞ কর্মচারীর সহায়তায় কিছুটা সহজ হয়ে উঠেছিল। ২০১২ সালে ফিরোজ এবং তার দল অরুণাচল প্রদেশের নামদাফা জাতীয় উদ্যানে একটি  ক্যামেরা ট্র্যাপিং প্রকল্প পরিচালনা করেন। নামদাফা প্রকল্পটি ছিল তার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ,  ফিরোজের দল এই প্রত্যাহবান গ্রহণ করেছিল এবং সফলভাবে  কাজটি সম্পন্ন করেছিল।

নামদাফা আরাকান ও পাটকাই পাহাড়ের পরিসরের অংশ। নামদাফায় যাওয়ার একমাত্র উপায় হল পাহাড় পেরিয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পৌঁছানো। পাহাড়গুলো খাড়া হওয়ায় হাঁটাচলা করা বেশ কঠিন। তাই ফিরোজ ও তার দল নিজেদের পথ নিজেরাই তৈরি করেছিল। তারা গুগল আর্থ প্রযুক্তির সাহায্য নিয়েছিল। স্থানীয় বনকর্মীরাও তাদের সহায়তা করেছিলেন, কারণ তারা নামদাফা সংলগ্ন এলাকার ভালো তথ্য রাখতেন।
 

ঘন অরণ্যে কাজের মধ্যে ফিরোজ আহমেদ
 
ফিরোজ বলেন, "অরণ্য এবং জীবনের বিষয়ে শেখার কোনো শেষ নেই। আমরা কাজের সময় কিছু চোরাশিকারীকেও ধরেছিলাম, যারা আমাদের ক্যামেরা ট্র্যাপিং ব্যবস্থাকে অনেক ক্ষতি করেছিল। এই প্রকল্পটি তিন মাস ধরে চলেছিল এবং অবশেষে আমরা নামদাফা থেকে প্রথমবারের মতো বাঘের ছবি ক্যামেরায় ধারণ করতে সক্ষম হই।”

ফিরোজ বলেন, বাঘ অরণ্যে ছবি তুলতে পছন্দ করে না। তারা অরণ্যের পরিবেশ খুব ভালোভাবে বোঝে, যেমন মানুষ নিজের ঘরের পরিবেশ বোঝে।
 

 
নিজের হাতে সেরা ছবিতে ক্লিক করেন ফিরোজ আহমেদ
 
এই বিপজ্জনক কাজের পেছনের মানুষটি হলেন ফিরোজ আহমেদ। তিনি আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত একজন বাঘ বিশেষজ্ঞ। ২০১০ সালে কাজিরাঙা জাতীয় উদ্যানে একটি প্রাপ্তবয়স্ক বাঘের ছবি তোলার পর তিনি সারা দেশে খ্যাতি অর্জন করেন। ছবিটি বিশ্লেষণ করে তিনি দেখতে পান কাজিরাঙায় বাঘের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি।

ফিরোজ ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত কাজিরাঙায় ক্যামেরা ট্র্যাপিং কার্যক্রমের নেতৃত্ব দেন। ২০০৭ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে তিনি ওরাং এবং মানস জাতীয় উদ্যানে বাঘ পর্যবেক্ষণ কার্যক্রমে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এই সময়ে তিনি নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। বিশেষ করে রাগান্বিত গন্ডার প্রায়ই তাদের তাড়া করত।
 

 
ফিরোজ আহমেদ পরিবারের সাথে
 
"আওয়াজ - দ্য ভয়েস"-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, কাজিরাঙায় বাঘ পর্যবেক্ষণের কাজ অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। পর্যবেক্ষণকারীকে বুঝতে হবে বাঘ কিভাবে আচরণ করে বিভিন্ন সময় ও পরিবেশে। এমনকি ক্যামেরা স্থাপন করার সময়ও বাঘের মতো চিন্তা করতে হয়। ক্যামেরার পথটি এমনভাবে তৈরি করতে হয় যাতে বাঘ সেখানে চলাচল করে।

ফিরোজ বলেন, "সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল বিপজ্জনক জন্তুদের উপস্থিতি, দের পাশ দিয়ে আমাদের চলতে হয় ক্যামেরা ঠিক করতে। আমরা অনেক সময় গন্ডার, মহিষ, বা হাতির সঙ্গেও মুখোমুখি হই। সবকিছু অতিক্রম করে আমরা ২০০৯ সালে বড় একটি সাফল্য পাই, যেখানে দেখা যায় কাজিরাঙায় প্রতি ১০০ বর্গ কিলোমিটারে সবচেয়ে বেশি বাঘ রয়েছে।"

ফিরোজকে সংবর্ধনা গ্রহন করতে দেখা যাছে
 
ফিরোজ বলেন, "বাঘ অরণ্যের পরিবেশের সামান্য পরিবর্তনও বুঝতে পারে। তারা মানুষের ঘামের গন্ধও শনাক্ত করতে পারে। প্রাপ্তবয়স্ক বাঘ ক্যামেরা নিয়ে চিন্তিত না হলেও তরুণ বাঘেরা ক্যামেরার আলোয় ভয় পায় এবং পরে সে জায়গা এড়াতে শুরু করে। তাই ক্যামেরার অবস্থান বদলাতে হয় এবং বাঘের বেশি ছবি সংগ্রহ করতে হয়। একটি বাঘ এবং একই অঞ্চলের অধিকাংশ বাঘের অনেক ছবি দরকার জনসংখ্যা অনুমানের জন্য। তাই আমরা আমাদের কৌশল দিয়ে বাঘকে ক্যামেরার সামনে আনতে সক্ষম হই।”

ফিরোজ বর্তমানে আসামে বাঘের সংখ্যা নিয়ে সন্তুষ্ট। তিনি বলেন, "বাঘের সংখ্যা বাড়ছে। পরবর্তী ১৫-২০ বছরে এটি দ্বিগুণ হতে পারে যদি মানস ব্যাঘ্র অভয়ারণ্যর মতো এলাকাগুলোতে বন ব্যবস্থাপনা আরও শক্তিশালী করা হয়। মানস জাতীয় উদ্যানে বাঘের সংখ্যা গত ১০ বছরে ১০ থেকে ৪৪ হয়েছে এবং আগামী ১০-১৫ বছরে তা দ্বিগুণ হবে।”

তার মতে, আসামের অন্যতম সম্ভাবনাময় বাঘের বাসস্থান ডিব্রু-শইখোয়া জাতীয় উদ্যান, যার অবস্থান পূর্ব অরুণাচল ও পূর্ব আসামের জন্য উৎস হিসেবে কাজ করে। দুর্ভাগ্যবশত, এই অঞ্চলে বাঘের সংখ্যা কমেছে। তিনি সর্বশেষ ২০১৩ সালে ডিব্রু-শইখোয়ায় বাঘ চিহ্নিত করেছিলেন।

মহম্মদ ফিরোজ আহমেদ বর্তমানে শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি সংস্থা ‘আরণ্যক’-এর একজন সংরক্ষণ বিজ্ঞানী (Scientist F)। তিনি বাঘ, সরীসৃপ এবং কমিউনিটি-ভিত্তিক প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনার উপর গবেষণা এবং সংরক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তিনি ৩০ সদস্যের একটি দলের নেতৃত্ব দেন।

তিনি জাতীয় বাঘ সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ (National Tiger Conservation Authority)-এর সাথে যুক্ত ছিলেন এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রকের বন উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ এবং প্রজনন বিশেষজ্ঞ দল - ইন্ডিয়ার সঙ্গেও যুক্ত।

তিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউটে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। থাইল্যান্ডে স্মিথসোনিয়ান ও গ্লোবাল এনভায়রনমেন্টাল এডুকেশন অ্যান্ড কনজারভেশন-এর সহায়তায় একটি পরিবেশ শিক্ষার কোর্স করেছেন।

ফিরোজ যুক্তরাষ্ট্রের কেপ মে, নিউ জার্সিতে কছপ সংরক্ষণ এবং কমিউনিটি উন্নয়নের উপর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তিনি ক্যালিফোর্নিয়া একাডেমি অফ সায়েন্স, আমেরিকান মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রি, ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রি, মিউজিয়াম অফ ভার্টিব্রেট জুলজি (যুক্তরাষ্ট্র), এবং লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের একজন ভিজিটিং সায়েন্টিস্ট।