মুকুট শৰ্মা , গুয়াহাটি ঃ
ঢাল নেই তরোয়াল নেই নিধিরামের লড়াই এমন মজা করে বলার দিন ফুরিয়েছে। হাঁ, এমনই বটে এতদিন তাঁর খোঁজ কেউ করেননি কিন্তু এবার আমাদের প্রতিবেদনে এমন এক ব্যাক্তিকে তুলে ধরব যিনি তাঁর সমরকলায় অস্ত্র ছাড়াই লড়াই করে জয়ী হবার মন্ত্র শেখাছেন।অভিনব আর অদ্ভুত সমরকলার জাদু তাঁর মন্ত্রে দীক্ষা গ্রহন করছেন ভারতীয় সেনা বাহিনী থেকে পুলিশ অবধি সবাই । সমরকলার জন্মস্থান হিসাবে পরিচিত চীনে উন্নত প্ৰশিক্ষণ গ্ৰহণ করে ফিরে এসে অসমের যুবক এখন ভারতীয় সেনার কয়েকটি স্পেশিয়েল বাহিনীর আমন্ত্ৰিত প্ৰশিক্ষক হিসাবে কাজ করছেন। ভারত-চীন সীমান্তের দেশের অতন্দ্ৰ প্ৰহরী তথা দেশের সশস্ত্ৰ বাহিনীকে তিনি শেখাছেন অস্ত্ৰ ছাড়াই লড়াই করার অভিনব কৌশল।
অসম পুলিশের নবগঠিত কমাণ্ডো দলকে অস্ত্রবিহীন যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তিনি।গুয়াহাটির সরুসজাই ক্ৰীড়া প্ৰক্লপে কেন্দ্রীয় সরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ ও অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মাদের সামনে ২৫৫১ জন কমাণ্ডো দলকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেবার পর তাদের সামরিক শক্তি প্রদর্শন করেন।এই বিশেষ প্রশিক্ষণ শেষে সামরিক শক্তি দেখিয়ে উপস্থিত সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। কেন্দ্রীয় সরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ এই প্রশিক্ষণ দেখে প্রশংসা ও করেন। অসম পুলিশ এবং ভারতীয় সেনা থেকে অস্ত্র-শস্ত্রের উচ্চমানের প্রশিক্ষণ নেওয়া কমাণ্ডো ব্যাটেলিয়নটিকে অস্ত্র ছাড়াই যুদ্ধ (Unarmed Combat) করার নতুন কৌশল শেখানো হয়েছে। যেকোনো জটিল এবং চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে তাদের এক মাসের Unarmed Combat Training দেওয়া হয়েছে।
অসমের জাতীয় স্তরের উশু, মুয়াই-থাই, কিক-বক্সিং খেলোয়াড় এবং জাতীয় স্তরের শরীরচর্চাবিদ, শক্তি প্রশিক্ষক, স্ট্রেংথ অ্যান্ড কন্ডিশনিং প্রশিক্ষক, সার্টিফাইড স্পোর্টস নিউট্রিশনিস্ট এবং মার্শিয়াল আর্টসের একাধিক শাখায় ব্ল্যাক বেল্ট অর্জনকারী প্রতিভাবান যুবক সাকিল ইনজামে এর আগে ভারতীয় সেনার বেশ কয়েকটি কমাণ্ডো ব্যাটেলিয়নকেও অস্ত্র ছাড়াই যুদ্ধ প্রশিক্ষণ প্রদান করেছেন।"প্ৰতিভা সম্পন্ন এই যুবক রাজ্যের প্রথমসারির এম এম এ ফাইটার সাকিল ইনজাম (MMA Fighter Shakil Injam)।
অস্ত্ৰ ছাড়াই লড়াই করার অভিনব কৌশলের প্রশিক্ষণ সাকিলের
শিক্ষা ও সাহিত্যর সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত একটি উচ্চশিক্ষিত পরিবারে জন্ম নেওয়া সাকিল স্বাভাবিকভাবেই ছিলেন একজন মেধাবী ছাত্র। অসম জাতীয় বিদ্যালয় থেকে হাইস্কুল পরীক্ষায় ডিস্টিংশনসহ উত্তীর্ণ হওয়ার পর তিনি ২০১৫ সালে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ পিতা ইসমাইল হোসেনের ইচ্ছা ছিল তাদের একমাত্র সন্তান সাকিলকে সংস্কৃতির অধ্যাপক হিসেবে গড়ে তোলার।
তিনি বলেন, 'আমার বাবা আমাকে সংস্কৃতির অধ্যাপক হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। মা চেয়েছিলেন আমি প্রশাসনিক সেবায় যোগ দিই। সেই অনুযায়ী, আমি শিক্ষাক্ষেত্রে ভালো ফলাফল অর্জন করেছিলাম। অসম জাতীয় বিদ্যালয় থেকে মেট্রিকে ডিস্টিংশনসহ উত্তীর্ণ হয়েছিলাম। এরপর শ্রীমন্ত শঙ্কর একাডেমিতে হায়ার সেকেন্ডারি ও দিসপুর কলেজে বিএ পড়ি। ২০১৫ সালে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করি। মা-বাবা যেহেতু কলা-সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত, তাই ছোটবেলায় তারা আমাকে সত্ৰীয়া নৃত্য ও গানের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেগুলো আমাকে আকর্ষণ করেনি। জীবনের অভিজ্ঞতা ও রোমাঞ্চ বাড়াতে কিছু ভিন্নতা আনতে চেয়েছিলাম এবং একদিন রোমাঞ্চকর কিছুটা করতে ও ভিন্ন কিছু করার লক্ষ্য নিয়ে একদিন সমরকলার প্রশিক্ষণ শুরু করি।" - আৱাজ্য দ্য ভইচের সাথে একটি সাক্ষাৎকারে সাকিল বলেন।
"অসমে প্রায় ৬ বছর ধরে কুংফু, কারাটে, টাইকোয়ানডো, উশু, জিমন্যাস্টিক্স, মুয়াই-থাই, এবং কিক বক্সিংয়ের প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর অবশেষে তিনি ২০১৬ সালে উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য চীনের হেনান প্রদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সেখানে তিনি চীনের একটি শীর্ষস্থানীয় উশু একাডেমি Yuntaishan International Wushu School-এ তিন মাস প্রশিক্ষণ নেন। এই একাডেমীটিকে চীনের আর্মি স্কুল হিসেবেও পরিচিতি পাওয়া যায়।"
প্রশিক্ষণ শিবির শেষে
"সমরকলার নতুন নতুন কৌশল শিখতে আমি সবসময় আগ্রহী। চীন থেকে ফিরে আমি হরিয়ানার গুরগাঁওতে মল্লযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। ভারতের প্রাচীন যুদ্ধকলা কলারিপায়াট্টু শিখতে কেরালায় তিন মাস কাটিয়েছেন। অসম থেকে তিনি জাতীয় স্তরে কুংফু, উশু, কিক-বক্সিং ইত্যাদি খেলায় অংশ নিয়েছেন এবং বেশ কয়েকটি পদক জয় করেছেন," বর্তমানে গুয়াহাটি মহানগরের চান্দমারী এলাকায় Legacy Combat MMA & Fitness নামক একটি জিমে বহু যুবক-যুবতীকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন চলা সাকিল ইনজাম ।
উল্লেখ্য, সমরকলায় বিরল প্রতিভার প্রমাণ রেখে সাকিল একজন জাতীয় পর্যায়ের শরীরচর্চাবিদও। তিনি জুনিয়র মিস্টার ইন্ডিয়া প্রতিযোগিতায় পঞ্চম স্থান অর্জন করেছিলেন। ক্রীড়ার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাকিলের এমন বহু ঈর্ষণীয় সাফল্যই ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আকৃষ্ট করেছিল। তারা ২০১৯ সালে অসমের দক্ষ সমরকলাবিদকে ইন্ডিয়ান আর্মির স্পেশাল ফোর্সকে প্রশিক্ষণ দিতে আমন্ত্রণ জানায়। দেশের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে চীন সীমান্তে পাহাড়ায় থাকা ভারতীয় সেনার বিভিন্ন রেজিমেন্টের জওয়ানদেরকে তিনি অস্ত্রবিহীন শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লড়ার কৌশল শিখিয়েছেন।"
"সাকিল বলেন, 'আমি ২০১৯ সাল থেকে ভারতীয় সেনার কিছু গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত আছি। তাদের স্পেশিয়াল ফোর্স বলা হয়। স্পেশিয়াল ফোর্সের জওয়ানদের আমি আনআর্মড কমব্যাট প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। প্রতি বছর প্রায় এক মাসের জন্য আমি আর্মির ক্যাম্পে যাই এবং জওয়ানদের অস্ত্রবিহীন যুদ্ধের কৌশল শেখাই। প্রতিবার বিভিন্ন স্থানে অনুশীলন ক্যাম্পগুলো অনুষ্ঠিত হয়। এইভাবে দেশ মায়ের সেবা করতে পারা আমার জন্য নিঃসন্দেহে গৌরবের বিষয়।অন্যদিকে, মিক্সড মার্শিয়াল আর্টস বা সমরকলার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে ড্রাগ বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবনের মতো সামাজিক ব্যাধি থেকে দূরে রাখা সম্ভব বলেই উল্লেখ করে জনপ্রিয় ফাইটার বলেন, 'মার্শিয়াল আর্টস আসলে একটি নীতি এবং যে এটি জীবনের অংশ যেই তার সাথে জড়িত থাকেন তিনি কখনো ড্রাগ বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবনের মতো কাজ করতে পারে না।'
'মার্শিয়াল আর্টসকে সাধারণ দৃষ্টিতে হিংসাত্মক মারপিট মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা নয়। এতে যথেষ্ট ধৈর্য, সংযম এবং শৃঙ্খলাবোধের প্রয়োজন। এই কলা রপ্ত করতে পারলে মানুষ কখনো রাস্তায় অযথা মারপিট করবে না। এখানে আসার পর একজন উগ্র মানুষও বুঝতে পারে যে এমএমএর মানে মারপিট নয়। পেশাদার ক্ষেত্রেও ফাইটের জন্য অনেক কিছু শিখতে হয়। গায়ের জোরে এখানে যুদ্ধে জয়ী হওয়া সম্ভব নয়। অসমে এই বিষয়ে যথেষ্ট প্রচার এবং প্রসারের প্রয়োজন রয়েছে, সাকিল জানান।সাকিল বলেন,এইভাবে দেশমাতাকে সেবা করার সুযোগ পাওয়া আমার জন্য নিঃসন্দেহে গর্বের বিষয়।"