“যখন সত্যের বিচার শুরু হয়”

Story by  Pallab Bhattacharyya | Posted by  Aparna Das • 25 d ago
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি
 
  পল্লব ভট্টাচার্য

২০২৫ সালের ১০ নভেম্বর সন্ধ্যায় দিল্লির লালকেল্লার কাছে ঘটে যাওয়া বিস্ফোরণ শুধু শহরের ওপর নৃশংস হামলাই ছিল না, বরং এক মুহূর্তেই জন্ম দিল সেই পরিচিত জাতীয় দৃশ্যপটের, দুর্যোগকে চোখের নিমেষে টেলিভিশনের বিচারে পরিণত করার তাড়াহুড়ো। সাদা হুন্ডাই আই২০ গাড়িটি আগুনে ফেটে যেতেই, যেখানে অন্তত দশজন নিহত হন এবং বহু মানুষ আহত হন, ঘটনাস্থল থেকেই গণমাধ্যম ভরাট করতে শুরু করল শূন্যতা, ছবি, অনুমান, নানা নাম এবং গল্পের বন্যায়, যা তদন্তকারী সংস্থা কিংবা আদালত নিশ্চিতভাবে কিছু বলার আগেই জনমতকে গঠন করতে শুরু করে দেয়।
 
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের অধিকার এবং ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারের মধ্যে যে টানাপোড়েন, সেটাই ভারতের দীর্ঘদিনের ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু। সংবিধানের ১৯(১)(ক) অনুচ্ছেদ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করলেও, ১৯(২) অনুচ্ছেদ সেই স্বাধীনতার ওপর যুক্তিসঙ্গত বিধিনিষেধ আরোপ করে, ন্যায়বিচার ও জনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে। ১৯৭১ সালের আদালত অবমাননা আইন আরও স্পষ্টভাবে জানায় যে বিচারাধীন মামলার ক্ষেত্রে কোনো রকম কুসংবাদ বা পক্ষপাতমূলক প্রতিবেদন করা ফৌজদারি আদালত অবমাননার শামিল, যা সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ন্যায়সঙ্গত প্রক্রিয়ার অধিকারকে সরাসরি প্রভাবিত করে। আদালত বারবার সতর্ক করেছে, নির্দোষের স্বাভাবিক অনুমানকে (presumption of innocence) চমকপ্রদ প্রতিবেদন বা তথাকথিত জনস্বার্থ সাংবাদিকতার আড়ালে ধ্বংস করা যায় না।
 
লালকেল্লা ভয়ানক বিস্ফোরণের পরবর্তীকালীন দৃশ্য
 
রাও হরনারায়ণ সিং শেখোজি সিং বনাম গুমানি রাম আর্যা মামলায় পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাই কোর্ট বলেছিল, সন্দেহভাজন বা সাক্ষীদের নিয়ে অনুমানভিত্তিক খবর বিচারব্যবস্থাকে বিপন্ন করে। আরও সম্প্রতি জেসিকা লাল মামলায় সুপ্রিম কোর্ট সংবাদমাধ্যমের শক্তি স্বীকার করলেও সতর্ক করে বলেছে, সে শক্তি যেন প্রতিরক্ষা পক্ষের অধিকার নষ্ট না করে কিংবা নিরপেক্ষ তদন্তকে বিঘ্নিত না করে। আর সাহারা ইন্ডিয়া রিয়েল এস্টেট কর্পোরেশন বনাম সেবি মামলায় আদালত এমনকি ‘পোস্টপোনমেন্ট অর্ডার’-এর প্রয়োজন স্বীকার করেছে, যাতে বিচার প্রক্রিয়া দূষিত না হয়।
 
কিন্তু এসব সুরক্ষা আজকের সংবাদমাধ্যমের গতি, রেটিং-চাহিদা এবং নাটকীয় ভিজুয়াল তৈরির প্রতিযোগিতার সামনে বেশিরভাগ সময়ই অকার্যকর হয়ে পড়ে। ইতিহাস বহুবার দেখিয়েছে, কীভাবে সংবাদ কাভারেজ বিচারকে বিকৃত করতে পারে। আরুশি তালওয়ার মামলায় টানা প্রাইমটাইম, অবিবেচক অভিযোগ ও অনুমানভিত্তিক গল্প আদালতের রায় ঘোষণার বহু আগেই বাবা-মাকে দোষী সাব্যস্ত করে, যদিও পরবর্তী সময়ে আদালত তাঁদের সম্পূর্ণ নির্দোষ ঘোষণা করে, কিন্তু ততক্ষণে তাঁদের জীবন ও মানসম্মান অপূরণীয় ক্ষতির মুখে পড়ে। আবার এর বিপরীতে রয়েছে জেসিকা লাল মামলার উদাহরণ, যেখানে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ও জনমত নতুনভাবে বিচারপ্রক্রিয়ার পথ খুলে দিয়ে শেষ পর্যন্ত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে।
 
এই দ্বৈততা, সংবাদমাধ্যম একদিকে রক্ষক, অন্যদিকে বিপদ, সবচেয়ে প্রকট হয়ে ওঠে সুশান্ত সিং রাজপুত মামলায়। সেখানে বোম্বে হাই কোর্ট একাধিক চ্যানেলকে কড়া ভর্ৎসনা করে বলেছিল, তাঁরা রিয়া চক্রবর্তীকে অপরাধী হিসেবে তুলে ধরেছে কোনো প্রমাণ ছাড়াই, যা ছিল আদালত অবমাননার পর্যায়ে।
 
লালকেল্লা ভয়ানক বিস্ফোরণের পরবর্তীকালীন দৃশ্য
 
এই প্রেক্ষাপটে লালকেল্লা বিস্ফোরণ এমন এক ঘটনা ছিল, যা চেয়েছিল অত্যন্ত সতর্ক, যাচাই করা, তথ্যভিত্তিক রিপোর্টিং, যা গণতন্ত্রের অপরিহার্য শর্ত। মামলাটি প্রকৃতই জটিল: ড. উমর মোহাম্মদের সম্পৃক্ততা, র‌্যাডিকালাইজড চিকিৎসকদের এক নেটওয়ার্ক, এনক্রিপ্টেড টেলিগ্রাম চ্যানেল, এবং কয়েক রাজ্যজুড়ে পাওয়া প্রায় ২,৯০০ কেজি বিস্ফোরক,  মিলিয়ে এক সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র, যার কেবল অল্প অংশই তদন্তকারীরা উদ্ধার করতে পেরেছেন। এনআইএ’র পরবর্তী গ্রেফতার, যার মধ্যে রয়েছে সেই আমির রশিদ মীর, যার নামে গাড়িটি রেজিস্টার্ড ছিল, ইঙ্গিত দেয় যে দিল্লি ও এনসিআর জুড়ে বহু গুরুত্বপূর্ণ স্থানে হামলার পরিকল্পনা ছিল তাদের। ইতিমধ্যেই সত্তরেরও বেশি সাক্ষীর জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে, প্রমাণ পরীক্ষা করা হয়েছে, রাজ্যজোড়া সংযোগ খতিয়ে দেখা হয়েছে, যা সবই দেখায় যে এই তদন্তের গুরুত্ব কত গভীর এবং এতে বিঘ্ন না ঘটানো কত জরুরি।
 
কিন্তু তদন্ত চলার মধ্যেই তৈরি হতে থাকে এক সমান্তরাল বয়ান। টিভি চ্যানেলগুলো দেখাতে শুরু করে বিস্ফোরক তৈরির ‘ব্যাখ্যামূলক ভিডিও’। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে এক ভুয়ো ভিডিও, যেখানে এক বিশাল অগ্নিগোলকের দৃশ্য দেখানো হয়েছিল। ভাইরাল হওয়ার পরে সরকার সেটিকে মিথ্যা বলে জানায়। যাঁদের আটক করা হয়েছিল এবং পরে প্রমাণের অভাবে ছাড়া হয়, তাঁদের নাম-পরিচয় ইতিমধ্যেই প্রাইমটাইমের আলোয় উঠে আসে, ফলে মুক্তি পাওয়ার পরও তাঁরা সামাজিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়েন। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক সতর্কতা জারি করে, সহিংসতাকে ‘গৌরবান্বিত’ করা বা জাতীয় নিরাপত্তা বিপন্ন করতে পারে এমন কনটেন্ট প্রচারের বিরুদ্ধে। ঘটনাটি আবারও দেখায়, ভুয়ো খবর, অসম্পূর্ণ তথ্য, চমকপ্রদ গ্রাফিক্স কীভাবে জনমতকে ভ্রান্ত করে, সাক্ষীর স্মৃতি বিকৃত করে, এবং ন্যায়বিচারকে বাধাগ্রস্ত করে।
 
দীর্ঘদিন ধরেই আদালত এই বিপদের কথা স্বীকার করে আসছে। ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ নিয়ে তাদের রায় বিশ্বব্যাপী উদ্বেগের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ, যেমন যুক্তরাষ্ট্রের Sheppard v. Maxwell মামলায় বা ব্রিটিশ আদালতের সেই সব রায়ে, যেখানে বাইরে পাওয়া তথ্য জুরিদের মনে পূর্বধারণা তৈরি করলে বিচার বাধাগ্রস্ত হয় মনে করা হয়। ভারতে জুরি ব্যবস্থা না থাকলেও বিপদটি অন্যভাবে আছে, বিচারকের চারদিকে যখন এক প্রবল জনবয়ান ঘুরে বেড়ায়, তখন বিচারকের সম্পূর্ণ ‘বিচ্ছিন্ন’ থাকার ধারণাটি অনেকসময় এক ধরনের আইনি কল্পকাহিনিতে পরিণত হয়, যা একসময় হরিশ সালভে ‘legal fiction’ বলেছিলেন।
 
লালকেল্লা বিস্ফোরণের কিছু ভুক্তভোগীদের পরিবারের কান্নায় ভেঙে পরার দৃশ্য
 
ক্ষতি শুধু অভিযুক্তদের নয়, ভুক্তভোগীদের পরিবারও যেন টেলিভিশনের নাটকীয় ভোগ্যপণ্যে পরিণত হয়। সাক্ষীরা ভয় ও প্রভাবের মুখে পড়েন। তদন্তকারীরা সত্য উদঘাটনের চেয়ে ‘দ্রুত ফলাফল’ দেখানোর চাপে থাকেন। সমাজও বিশ্বাস হারায়, যখন মনে হয় ন্যায়বিচার দৃষ্টান্ত নয় বরং শিরোনাম তৈরি করছে। লালকেল্লার ছায়ায় ঘটে যাওয়া এই বিস্ফোরণ, এক স্মৃতিস্তম্ভের পাদদেশে, যা ভারতের সাংবিধানিক অঙ্গীকারের প্রতীক, পুনরায় বুঝিয়ে দিল, তথ্য ও বিনোদনের সীমানা ভেঙে গেলে জনআস্থা কত সহজে ভঙ্গুর হয়ে পড়ে।
 
তবু সামনে পথ সেন্সরশিপ নয়, আত্মসমর্পণও নয়। পথটি হলো, নৈতিক আত্মনিয়ন্ত্রণকে শক্তিশালী করা, প্রয়োজনে আদালত অবমাননা আইন প্রয়োগ করা, সংবাদমাধ্যমকে যথার্থতা ও যাচাইয়ের দায়বদ্ধতায় ফিরিয়ে আনা, ভুল তথ্য সংশোধনের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করা, এবং নাগরিকদের মধ্যে মিডিয়া-সচেতনতা বাড়ানো। স্বাধীন, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা, যা নিরপেক্ষতা, যাচাই, ও দায়বদ্ধতার ওপর দাঁড়িয়ে, গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু সস্তা চমকপ্রদতা কেবল ভয়কে পুঁজি করা লোকদেরই লাভ দেয়।
 
শেষ পর্যন্ত, লালকেল্লা বিস্ফোরণের ভুক্তভোগীরা এমন ন্যায়বিচার প্রাপ্য, যা শোরগোল, পক্ষপাত বা অনুমানের ছোঁয়া থেকে মুক্ত। যদি এই ট্র্যাজেডি আমাদের কিছু শেখায়, তবে তা হলো, সত্যের জন্য প্রয়োজন ধৈর্য, সাহস এবং সংযম, যে গুণগুলি সাংবাদিকতাকে ফিরিয়ে আনতে হবে জনবিশ্বাসের যোগ্যতায়। কারণ ন্যায়বিচারের পথ যখন বিনোদনের অংশে পরিণত হয়, তখন জাতি কাঁদে শুধু মৃতদের জন্য নয়, তার বিচারব্যবস্থার প্রতি বিশ্বাসের ক্ষয়ের জন্যও।
 
(লেখক: অসম সরকারের অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ মহাপরিচালক; প্রাক্তন অসম লোকসেবা কমিশনের চেয়ারম্যান এবং ‘আওয়াজ – দ্যা ভয়েস অসম’-এর মুখ্য কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা)