দিল্লি বিস্ফোরণ: ইসলামী র‌্যাডিকালাইজেশনের অদৃশ্য কুয়াশা

Story by   Atir Khan | Posted by  Aparna Das • 24 d ago
বিস্ফোরণের পর নয়াদিল্লি রেলওয়ে স্টেশনে নিরাপত্তা বাহিনী।
বিস্ফোরণের পর নয়াদিল্লি রেলওয়ে স্টেশনে নিরাপত্তা বাহিনী।
 
  আতির খান

ভারতে ইসলামী র‌্যাডিকালাইজেশন ছড়িয়ে পড়ছে নিঃশব্দে, যেমন রাতের আঁধারে কুয়াশা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে, চোখে না পড়লেও বিশ্বাস আর উগ্রতার সীমারেখাকে ঝাপসা করে দেয়। এই কুয়াশার রূপ তখনই মৃত্যুর রূপ নিল, যখন গত সোমবার দিল্লির শান্তি ভেঙে লালকেল্লার কাছে একটি গাড়ি বিস্ফোরণে শহর কেঁপে উঠল। ১৯৯০-এর দশকের সন্ত্রাসময় দিনগুলির স্মৃতি জাগিয়ে তোলা এই বিস্ফোরণে দশজনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে, বহু আহত হয়েছে, এক মুহূর্তেই বছরের পর বছর ধরে টিকে থাকা নাজুক শান্তি ভেঙে পড়ল।
 
আরও গভীর ধাক্কা লাগে, যখন তদন্তকারীরা জানলেন, এই ষড়যন্ত্রের পেছনে যারা ছিল তারা কোনো পেশাদার জঙ্গি নয়, বরং চিকিৎসক, যারা জীবনের রক্ষক হওয়ার শপথ নিয়েছিল। অভিযোগ, অভিযুক্তরা ৩৮০ কেজি অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট ব্যবহার করে বিস্ফোরণের ছক কষেছিল, এবং তারা একা কাজ করছিল না।
 
ড. মুজাম্মিল শাকিল ও ড. উমর উন নবির ড্রাইভিং লাইসেন্স
 
তাদের পদচিহ্ন ভারতে সীমাবদ্ধ নয়। ২০২০ সালে ডা. উমের, ডা. মুজাম্মিল ও ডা. আদেল এক ডা. উকশার আমন্ত্রণে তুরস্কে যান। কিন্তু সেই আতিথেয় কখনও হাজির হননি। তার জায়গায় হাজির হন “জান ভাই” নামের এক ব্যক্তি, যিনি নিজেকে কাশ্মীরি বলে দাবি করেন। তাদের তুরস্কে অবস্থানের সময়, এই চিকিৎসকেরা সিরিয়া, জর্দান ও প্যালেস্টাইনের লোকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, যে সাক্ষাৎ এখন আর বন্ধুত্বপূর্ণ নয়, বরং কৌশলগত বলে মনে হচ্ছে।
 
দেশে ফিরে তারা এনক্রিপটেড টেলিগ্রাম চ্যাট, হোয়াটসঅ্যাপ ও সিগন্যালের প্রাইভেট গ্রুপগুলোকে তাদের ভার্চুয়াল বৈঠকের ঘর বানিয়ে নেন। ডা. মুজাম্মিল ও ডা. উমের ফরিদাবাদের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন, সেখানে তাদের কার্যকলাপের ঘাঁটি তৈরি করেন, এমনকি স্থানীয় ড্রাইভিং লাইসেন্সও সংগ্রহ করেন যাতে সাধারণ নাগরিকের মতো মিশে যেতে পারেন।
 
তদন্তকারী সংস্থার মতে, ৪৭ বছর বয়সী তালাকপ্রাপ্তা ডা. শাহিনা, যিনি ৩৩ বছর বয়সী ডা. মুজাম্মিলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন, তিনিই ₹২২ লক্ষ টাকা জোগাড় করেছিলেন বিস্ফোরণের উপকরণ কেনার জন্য।প্রমাণ অনুযায়ী, তাদের যোগাযোগ ও অর্থায়নের সূত্র আইএসআইএস ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনের হ্যান্ডলারদের পর্যন্ত পৌঁছেছিল।
 
লালকেল্লা ভয়ানক বিস্ফোরণের একটি ছবি
 
যখন টিভি সংবাদদল লখনউয়ে ডা. শাহিনার বাড়িতে পৌঁছায়, তখন দেখা যায় তার বৃদ্ধ পিতা হতভম্ব, একজন মানুষ যিনি বুঝে উঠতে পারছেন না কীভাবে একসময় গর্বের প্রতীক তার সন্তানরা এখন দেশদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত।
 
তিনি বললেন, “এইসব ঘটনা পুরো মুসলিম সমাজের নাম খারাপ করবে। এখন থেকে টুপি, কুর্তা আর পায়জামা পরা প্রতিটি মানুষ সন্দেহের চোখে দেখা হবে।” যখন বৃদ্ধ মানুষটিকে টিভি রিপোর্টাররা প্রশ্নবাণে জর্জরিত করছিল, তিনি থেমে থেমে উত্তর দিচ্ছিলেন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন তার সন্তানরা মেধাবী, তারা দেশের সবচেয়ে কঠিন মেডিকেল পরীক্ষা উত্তীর্ণ হতে সংগ্রাম করেছে। সম্ভবত সেই বিরতিগুলোর মাঝেই তিনি ভাবছিলেন, কোনো ইঙ্গিত কি তিনি মিস করেছিলেন? যদি আগে বুঝতে পারতেন, তবে কি সন্তানদের র‌্যাডিকালাইজড হওয়া থামানো যেত?
 
পুরনো দিল্লির এক সরু গলিতে, সাংবাদিকরা যখন লালকেল্লা বিস্ফোরণে নিহত ব্যাটারি-রিকশা চালক মোহসিন আলির বাড়িতে গেলেন, তখন প্রতিটি মুখে লেখা ছিল শোক। তার বিধবা স্ত্রী আর দুই স্কুলপড়ুয়া সন্তান আজও স্তব্ধ, নিস্তব্ধ ব্যথায় পাথর হয়ে আছেন। পাড়া-প্রতিবেশীরা ফিসফিস করে সান্ত্বনা আর আতঙ্ক, এখন ওদের দেখাশোনা করবে কে?
 
তদন্তকারীদের ধারণা, ডাক্তারদের এই উগ্রতার পথে যাত্রা শুরু হয়েছিল শ্রীনগরে, যেখানে এক ধর্মীয় নেতা নাকি ডা. মুজাম্মিল ও ডা. উমেরকে বলেছিলেন, তারা “একটি উচ্চতর উদ্দেশ্যে নির্বাচিত”, জীবন রক্ষার জন্য নয়, বরং এক “দিব্য কর্তব্য” পালনের জন্য। বিদ্রূপ এই যে, অনেক সময় মেধাবীরাই সহজে প্রভাবিত হয়; তাদের যুক্তি হারিয়ে যায় না, কেবল ভুল পথে পরিচালিত হয়।
 
লালকেল্লা ভয়ানক বিস্ফোরণের একটি ছবি
 
এক আলাদা অভিযানে, গুজরাটের অ্যান্টি-টেররিজম স্কোয়াড সম্প্রতি হায়দরাবাদের চিকিৎসক আহমেদ মোহিয়ুদ্দিন সৈয়দকে গ্রেপ্তার করেছে, যিনি চীনে শিক্ষালাভ করেছিলে, তার দুই সহযোগীসহ। অভিযোগ, তারা ক্যাস্টর বীজ থেকে রিসিন নামের মারাত্মক বিষ প্রস্তুত করছিলেন, যা দিয়ে জীবাণু অস্ত্র ব্যবহার করে সন্ত্রাসী হামলা চালানোর পরিকল্পনা ছিল। তারা ইতিমধ্যে লখনউ, দিল্লি ও আহমেদাবাদে নজরদারি চালিয়েছিল। এই গ্রেপ্তারের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক জঙ্গি নেটওয়ার্কের সঙ্গে তাদের ভয়ঙ্কর যোগাযোগের সূত্র মেলে, যেখানে রাসায়নিক অস্ত্র নিয়ে পরীক্ষা চলছে।
 
শিক্ষিত পেশাজীবীদের এইভাবে সন্ত্রাসী চক্রান্তে জড়িয়ে পড়া এক গভীর প্রশ্ন উত্থাপন করে,কীভাবে বুদ্ধিমত্তা আদর্শে পরিণত হয়? যারা একসময় জীবন রক্ষার শপথ নিয়েছিল, তারা মৃত্যুর হাতিয়ার হয়ে উঠল। তাদের এই পতন প্রমাণ করে, যখন বিশ্বাস থেকে সহানুভূতি বিচ্ছিন্ন হয়, তখন যুক্তিবুদ্ধি কেমন সহজে বিকৃত হয়ে যায়।
 
তাদের বিশ্বাস করানো হয়েছিল যে ধর্মের জন্য মৃত্যু মহৎ। তারা ভুলে গিয়েছিল যে প্রকৃত বিশ্বাসের পরীক্ষা মৃত্যু নয়, জীবন, সম্মানের সঙ্গে বাঁচা, পরিবার, পেশা ও দেশকে সততার সঙ্গে সেবা করা। জীবনের চেয়ে বড় কোনো “পবিত্র উদ্দেশ্য” নেই। কোনো সভ্যতাই নিখুঁত নয়। একে টিকিয়ে রাখে ক্ষোভ নয়, মনোভাব, স্পষ্টভাবে ভাবার সাহস, ঘৃণাকে প্রতিরোধ করার শক্তি, আর জীবনকে আদর্শের ঊর্ধ্বে বেছে নেওয়ার প্রজ্ঞা।
 
লালকেল্লা ভয়ানক বিস্ফোরণের পরবর্তীকালীন দৃশ্য
 
ভারতের চ্যালেঞ্জ কেবল শাস্তি দেওয়া নয়, প্রতিরোধও করা। রাষ্ট্রকে কঠোর হাতে সন্ত্রাস দমন করতে হবে, তবে পাশাপাশি ডি-র‌্যাডিকালাইজেশনের একটি প্রচারও চালাতে হবে, যা মনকে ছোঁবে, তার আগেই যখন তা অন্ধ কুয়াশায় ঢেকে যায়।
 
এই লড়াইয়ে প্রত্যেক ভারতীয়কে অংশ নিতে হবে, ধর্ম নির্বিশেষে। অভিভাবক, শিক্ষক ও সমাজনেতাদের উচিত তরুণ প্রজন্মের প্রতি নজর রাখা, অবিশ্বাস নিয়ে নয়, যত্ন নিয়ে, যাতে তারা উগ্রতাকে কখনও বিশ্বাস বলে ভুল না করে। কারণ র‌্যাডিকালাইজেশন কখনও গর্জন করে আসে না; এটি আসে নিঃশব্দে, একটি কুয়াশার মতো, যা চোখ ঢাকে, তারপর পুড়িয়ে দেয়।