“চিত্রে চিরজীবী জুবিন”, ইমাম, ইমরান ও মিন্নাতুলের অনন্য উদ্যোগ

Story by  Ariful Islam | Posted by  Aparna Das • 17 d ago
গুয়াহাটি রাজধানী মসজিদের দেয়ালে  অংকন করা জুবিন গার্গের ছবি, গান ও কবিতা
গুয়াহাটি রাজধানী মসজিদের দেয়ালে অংকন করা জুবিন গার্গের ছবি, গান ও কবিতা
 
আরিফুল ইসলাম / গুয়াহাটি

অসমের প্রাণ, হার্টথ্রব জুবিন গার্গকে হারিয়ে তিন সপ্তাহ কেটে গেল। কিন্তু এখনো যেন কেউই বিশ্বাস করতে পারছে না যে জুবিন আর নেই। সকলেই শ্রদ্ধাঞ্জলি ও নানান স্মৃতিচারণমূলক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাকে স্মরণ করছে। সেই অমলিন স্মৃতিকে ধরে রাখতে, তাকে শিল্পে ও অনুভবে চিরজীবী করে রাখতে, গুয়াহাটির রাজধানী মসজিদের কাছেই শুরু হয়েছে এক আবেগঘন প্রয়াস। 
 
ইমাম আলী নামের এক চিত্রশিল্পী আঁকছেন জুবিন গার্গের ছবি, লিখছেন গান ও কবিতা। চিত্রশিল্পীর বাড়ি ধুবরির বিদ্যাপাড়া এলাকায়। সক্রিয় সমাজকর্মী মিন্নাতুল ইসলাম-এর নেতৃত্বে এবং ইমরান আলীর সহযোগিতায় নেওয়া হয়েছে এই স্নেহভরা উদ্যোগ।
 
দেয়ালে জুবিন গার্গের ছবি অংকন করার একটি দৃশ্য
 
জুবিনের প্রতিকৃতি আঁকার পাশাপাশি তার প্রিয় গান ‘মায়াবিনী রাতির বুকু’, এর কয়েকটি পঙ্‌ক্তিও লেখা হয়েছে দেয়ালে। তাছাড়া মিন্নাতুল ইসলাম জুবিন গার্গকে বিশ্লেষণ করে একটি ছোট কবিতাও দেয়ালে এঁকেছেন:
 
"জুর পরি যায়
বিভিন্ন জাতি-উপজাতির মন,
ন-পুরণির হিয়ার আমঠু,
শান্তিরে আগুয়াই যাম,
লেখার আঁড়ে আঁড়ে তোমাকে বিচারি পাম।"
 
সমাজকর্মী মিন্নাতুল ইসলাম বলেন, “জুবিনদা আমাদের যে সৃষ্টিসমূহ উপহার দিয়ে গেছেন, তা আমাদের প্রাণে প্রাণে থাকবে। তিনি অসম ও প্রতিটি অসমীয়ার হৃদয়ে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সহজ-সরল মানুষ, ঈশ্বরতুল্য। আজও আমরা মেনে নিতে পারছি না যে তিনি আর নেই। জুবিন গার্গের অনুপস্থিতি অসমের সাংস্কৃতিক জগতে এক অপূরণীয় ক্ষতি। আমাদের উচিত তার সৃষ্টিকে নতুনভাবে চিন্তা করা এবং তাকে আমাদের মাঝে চিরজীবিত রাখা।”
 
তিনি আরও বলেন, “আমরা ভাবলাম, কীভাবে তাকে জীবিত রাখা যায়। প্রথমে আমরা তার একটি ছবি আঁকলাম। সুদূর ধুবরি থেকে আমরা এক চিত্রশিল্পীকে আমন্ত্রণ জানালাম। আমাদের আহ্বানে ইমাম আলী গুয়াহাটিতে এসে অত্যন্ত সুন্দরভাবে জুবিনদার প্রতিকৃতি অঙ্কন করলেন। তার প্রিয় গান ‘মায়াবিনী’টিও দেয়ালে লিখে দিলাম। আমি নিজেই তাকে নিয়ে ছোট একটি কবিতা লিখেছি। আমার দুঃখ লাগে, তিন-পাঁচ বছরের বাচ্চারা জুবিনদাকে জীবিত অবস্থায় দেখেনি, কিন্তু ঘুমানোর আগে তারা মায়ের কাছ থেকে তার গান শোনে। জুবিনদা যে এখন আমাদের মধ্যে নেই, কেন নেই? কেন এমন হলো?, তার তদন্ত হওয়া উচিত। জুবিনদার ন্যায়ের জন্য আজও অসমবাসী অপেক্ষায়।”
 
উল্লেখযোগ্য, ইমাম আলী গত ১২ বছর ধরে চিত্রকলার সঙ্গে যুক্ত এবং তিনি জুবিন গার্গের গান শুনেই কাজ করতে ভালোবাসেন। তার মতে, জুবিনের গানই তার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। “আমি অসমের বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ করছিলাম, কে হুবহু জুবিনদার মতো ছবি আঁকতে পারে। দিলওয়ার রহমান নামের এক বন্ধু ইমাম আলীর কথা বলল, যিনি এটি করতে পারবেন। আমরা তার সঙ্গে যোগাযোগ করে গুয়াহাটিতে আমন্ত্রণ জানালাম। তিন দিন থেকে তিনি অসাধারণভাবে ছবিটি এঁকেছেন। আমি তাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। তার শিল্প আমরা অর্থ দিয়ে পূর্ণ করতে পারব না। আমি তার জন্য প্রার্থনা করি, যেন তার হাত আরও শক্তিশালী হয় এবং তিনি সুস্থ, দীর্ঘায়ু জীবন লাভ করেন,” বলেন মিন্নাতুল ইসলাম।
 
গুয়াহাটি রাজধানী মসজিদের দেয়ালে জুবিন গার্গের ছবি অংকন করার দৃশ্য
 
উল্লেখ্য, ‘আমার কোনো জাতি নেই, কোনো ধর্ম নেই’, এই কথা যিনি বলেছেন, সেই শিল্পী আমাদের মানবতার পথ দেখিয়ে গেছেন। তিনি অসমকে একত্রিত করে গেছেন। তার নাম নিয়ে ধর্মীয় বিভাজন না ঘটানোরও আহ্বান জানান মিন্নাতুল ইসলাম।
 
তিনি আরও বলেন, “জুবিনদা ৪০টি ভাষায় প্রায় ৪০ হাজার গান গেয়ে গেছেন, যার মধ্যে ৫ হাজার গান তিনি নিজেই লিখেছেন। তার অনুরাগীরা কখনও ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত হয়নি। জুবিন গার্গ কোনো ধর্মীয় বন্ধনে আবদ্ধ নন। তিনি নিজেই এক সত্তা, এক উৎসব। তার মৃত্যুর পর জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে এক করে গেছেন তিনি। এখন ধর্মের নামে বিভাজনের চেষ্টা না করাই ভালো। বিভিন্ন স্থানে এই বিষয়ে নানা কথা শোনা যাচ্ছে, কিন্তু জুবিন গার্গ ধর্মের ঊর্ধ্বে, এবং তাকে সেভাবেই থাকতে দিন। তিনি সেই অদেখা স্রষ্টা, যার সৃষ্টির তুলনা হয় না,” বলেন তিনি।
 
স্থানীয় বাসিন্দারাও এই প্রয়াসের প্রশংসা করেছেন। তারা একে অসমের সাংস্কৃতিক চেতনা সংরক্ষণ ও উদযাপনের এক অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে অভিহিত করেছেন।