দেবকিশোর চক্রবর্তী
পশ্চিমবঙ্গে ভোটার তালিকা সংশোধনের বিশেষ প্রক্রিয়া বা এসআইআর (Special Intensive Revision) ঘিরে নতুন করে উদ্বেগে পড়েছে রাজ্যের বৃহত্তম তফসিলি সম্প্রদায়গুলির অন্যতম মতুয়া সমাজ। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী জেলা ও মতুয়া অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে এই প্রক্রিয়া নিয়ে বাড়ছে অনিশ্চয়তা। গাইঘাটা বিধানসভা কেন্দ্রের বিজেপি বিধায়ক সুব্রত ঠাকুর নিজেই এই পরিস্থিতিকে “আসন্ন সংকট” বলে স্বীকার করায় বিষয়টি নতুন মাত্রা পেয়েছে।
মতুয়া সমাজ মূলত উদ্বাস্তু ও অভিবাসী পরিবারগুলির উত্তরসূরি, যাঁদের বড় অংশ এখনও নাগরিকত্ব সংক্রান্ত নথিপত্রের সমস্যায় ভুগছেন। এসআইআর প্রক্রিয়ায় ভোটার তালিকা নতুন করে যাচাই করার সময় পরিচয় ও নাগরিকত্ব সংক্রান্ত দলিলের উপর অতিরিক্ত জোর দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ। এর ফলে বহু মতুয়া ভোটারের নাম বাদ পড়তে পারে, এই আশঙ্কাই এখন সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ।
গাইঘাটা, বনগাঁ, ঠাকুরনগর-সহ উত্তর ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ অংশে মতুয়া সমাজের বসবাস। এই অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরেই মতুয়া ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির কেন্দ্রে রয়েছে। বিধায়ক সুব্রত ঠাকুর প্রকাশ্যে বলেছেন, এসআইআর প্রক্রিয়া সঠিকভাবে পরিচালিত না হলে বহু প্রকৃত ভোটার তাঁদের ভোটাধিকার হারাতে পারেন। তাঁর বক্তব্য, “মতুয়া সমাজের অনেক মানুষ আজও নাগরিকত্ব সংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ নথি জোগাড় করতে পারেননি। এই বাস্তবতা উপেক্ষা করলে বড় সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা তৈরি হবে।”
বিধায়কের এই মন্তব্য রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ সুব্রত ঠাকুর শাসক ভারতীয় জনতা পার্টি-র নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং মতুয়া সমাজের প্রভাবশালী ঠাকুর পরিবারের সদস্য। অতীতে বিজেপি মতুয়া সমাজকে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) নিয়ে আশ্বাস দিয়ে বড় রাজনৈতিক সমর্থন আদায় করেছিল। কিন্তু বাস্তবে নাগরিকত্ব সংক্রান্ত জটিলতা এখনও পুরোপুরি কাটেনি, এই অভিযোগ বহু মতুয়া পরিবারের।
মতুয়া সমাজের প্রতিনিধিদের বক্তব্য, এসআইআর-এর নামে যদি কঠোর নথি যাচাই শুরু হয়, তবে উদ্বাস্তু পটভূমি থাকা বহু পরিবারের ভোটার কার্ড বাতিল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাঁদের মতে, ভোটাধিকার হারানো মানে শুধু রাজনৈতিক অধিকার নয়, সামাজিক স্বীকৃতিও প্রশ্নের মুখে পড়া। মতুয়া মহাসংঘের একাংশের নেতারা ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছে স্বচ্ছ ও মানবিক প্রক্রিয়ার দাবি জানিয়েছেন।
অন্যদিকে প্রশাসনের তরফে দাবি করা হচ্ছে, এসআইআর প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য ভুয়ো ভোটার বাদ দেওয়া এবং প্রকৃত ভোটারদের অধিকার সুরক্ষিত করা। তবে মাঠপর্যায়ে কীভাবে এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়িত হবে, তা নিয়েই সবচেয়ে বেশি সংশয়। স্থানীয় স্তরে বিএলও ও প্রশাসনিক কর্মীদের সিদ্ধান্তের উপর অনেক কিছু নির্ভর করবে বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আসন্ন লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনের আগে এসআইআর যদি বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়, তবে তার সরাসরি প্রভাব পড়বে মতুয়া ভোটব্যাঙ্কে। এই পরিস্থিতিতে বিজেপি যেমন চাপে পড়তে পারে, তেমনই বিরোধী দলগুলিও বিষয়টিকে রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।
সব মিলিয়ে, এসআইআর ঘিরে তৈরি হওয়া অনিশ্চয়তা শুধু প্রশাসনিক নয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটের দিকেই ইঙ্গিত করছে। সুব্রত ঠাকুরের স্বীকারোক্তি সেই আশঙ্কাকেই আরও স্পষ্ট করেছে। এখন দেখার বিষয়, সরকার ও নির্বাচন কমিশন কীভাবে মতুয়া সমাজের উদ্বেগ দূর করে ভোটাধিকার সুরক্ষার আশ্বাস দেয়।