দেবকিশোর চক্রবর্তী
উত্তরবঙ্গের ভয়াবহ দুর্যোগের তিন দিন পার হলেও পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে এখনও সময় লাগবে। নতুন করে আর বৃষ্টি না-হওয়ায় বিপর্যস্ত এলাকায় স্বস্তির হাওয়া বইছে। তবে ধস ও ভাঙা সেতুর কারণে পাহাড়ের সঙ্গে সমতলের সরাসরি যোগাযোগ এখনও বিচ্ছিন্ন। সরকারি প্রশাসন, সেনা ও বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের কর্মীরা দিনরাত এক করে উদ্ধার ও মেরামতির কাজে নামলেও পাহাড়ের মানুষ এখনও কার্যত অবরুদ্ধ।
দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়াং, মিরিক এবং আশেপাশের এলাকায় একাধিক স্থানে ধস নামার ফলে জাতীয় সড়ক ১০-এর একাধিক অংশ বন্ধ হয়ে পড়েছে। শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং কিংবা কালিম্পং যাওয়ার মূল পথেই ধসের স্তূপ জমে আছে। ফলে পর্যটক এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের এখন ঘুরপথে যাতায়াত করতে হচ্ছে। অনেকে বিকল্প হিসেবে পুরনো পাহাড়ি পথ বা তিস্তা নদীর পাশ দিয়ে দীর্ঘপথ ঘুরে গন্তব্যে পৌঁছাচ্ছেন। এতে সময় যেমন বেশি লাগছে, তেমনি ঝুঁকিও রয়ে যাচ্ছে প্রবল।
পাহাড়ি অঞ্চলে যাতায়াতের প্রধান সেতুগুলির মধ্যে একাধিক সেতু প্রবল জলের তোড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কালিম্পংয়ের লোভার সেতু, সিকিম সীমান্তের কাছে রংপো সেতু এবং দার্জিলিংয়ের পাগলাঝোরা অঞ্চলের সংযোগ সেতু আংশিক ভেঙে পড়েছে। এই সেতুগুলি মেরামতির কাজ শুরু হলেও তা সম্পূর্ণ হতে আরও কয়েক দিন সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন সেচ ও জলপথ দফতরের আধিকারিকরা।
রাজ্য প্রশাসনের পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও এনডিআরএফ (জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী) ইতিমধ্যেই উদ্ধারকাজে যুক্ত হয়েছে। হেলিকপ্টারের মাধ্যমে খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে পাহাড়ের প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে। অনেক গ্রামেই এখনও বিদ্যুৎ ও মোবাইল যোগাযোগ বন্ধ। প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে, ধস সরিয়ে রাস্তাগুলি চালু করা ও সেতুগুলি মেরামত করাই এখন প্রধান অগ্রাধিকার।
রাজ্য সরকারের এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক জানান, “ধসের কারণে যে ক্ষতি হয়েছে, তা ব্যাপক। প্রায় ৪০টিরও বেশি রাস্তায় আংশিক বা সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। আমাদের দল নিরন্তর কাজ করছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ৫-৭ দিনের মধ্যে আংশিক স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।”
পাহাড়ের বাজারগুলি এখনও পুরোপুরি খোলেনি। তাজা সবজি, দুধ ও ওষুধের জোগানে টান পড়েছে। শিলিগুড়ি থেকে পণ্যবাহী গাড়ি অনেকটাই বন্ধ থাকায় দাম বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের। পর্যটন শিল্পও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। পুজো মরসুমের আগে এমন দুর্যোগে হোটেল ও ট্রাভেল ব্যবসায়ীরা দিশেহারা। অনেক পর্যটক যাত্রা বাতিল করেছেন, আবার যারা পাহাড়ে আটকে রয়েছেন, তাঁদের ফেরানোর ব্যবস্থা করতে হিমশিম খাচ্ছে প্রশাসন।
আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, আগামী কয়েক দিন উত্তরবঙ্গে ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা নেই। তবে পাহাড়ের মাটি অতিসিক্ত হয়ে থাকায় সামান্য বৃষ্টিতেও ফের ধসের আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এমন প্রবল বর্ষণ ও আকস্মিক ধসের ঘটনা ভবিষ্যতে আরও ঘন ঘন ঘটতে পারে।
যদিও বৃষ্টি থেমেছে এবং আংশিকভাবে স্বস্তি ফিরেছে, তবু পাহাড়বাসীর মনে এখনো একটাই প্রশ্ন—কবে আবার স্বাভাবিক হবে যাতায়াত? দার্জিলিং থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত সরাসরি রাস্তায় গাড়ি চলাচল কবে শুরু হবে, তার সুনির্দিষ্ট উত্তর দিতে পারছেন না কেউই। সেতু ও রাস্তা মেরামতির কাজ পুরোদমে চলছে, কিন্তু পাহাড়ের প্রকৃতি অনিশ্চিত।
এক প্রবীণ বাসিন্দা বললেন, “প্রতি বছরই এমন দুর্যোগের মুখোমুখি হচ্ছি। সরকার সাহায্য করে, কিন্তু টেকসই সমাধান দরকার। পাহাড়ের জীবন এমন বিপর্যয়ের মধ্যেই কেটে যাচ্ছে।”
দুর্যোগের পর তিন দিন কেটে গেলেও উত্তরবঙ্গ এখনো ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। প্রকৃতির রোষে ক্ষতবিক্ষত এই পাহাড় আবার কবে পূর্ণ প্রাণে জেগে উঠবে—সেই অপেক্ষাতেই আজ গোটা উত্তরবঙ্গ।