পুলিন ডেকাঃ
আধুনিক সংবাদ মাধ্যমে এক রূপান্তরমুখী যাত্রা পথে অগ্রসর হওয়ার সময়ে আজকের তথ্য প্রযুক্তির জগতে এর গুরুত্ব ও তাৎপর্যই স্বতন্ত্র রূপ পেয়েছে। মুদ্রিত ও ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ছাড়াও সামাজিক মাধ্যম, অনলাইন নিউজ পোর্টাল, মেসেঞ্জার অ্যাপ ইত্যাদি সংবাদসেবার প্রকৃতি পরিবর্তন করে ফেলেছে। প্রতিটি খবর সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে কেবল কয়েক মুহূর্তের প্রয়োজন হয়। এই দ্রুততার কারণে সংবাদমাধ্যমের জনপ্রিয়তা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এটি আন্তর্জাতিক মঞ্চেও গুরুত্বপূর্ণ উপস্থিতি অর্জন করেছে।
গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে সংবাদমাধ্যম সমাজের একটি শক্তিশালী উপাদান। সভ্যতার অটুট যাত্রার শক্তি। সংবাদমাধ্যমের চিন্তাভাবনা ও পরিবর্তনমুখী দৃষ্টিভঙ্গি আজকের জটিল বিশ্বে আলোর সেতু নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে সংবাদমাধ্যম কীভাবে তার বিশ্বাসযোগ্যতা অটুট রাখতে পারে, সেটিই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সঠিক খবর শুধু সামাজিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে না, মানুষের মুক্তমনা চিন্তার বিকাশও সম্ভব করে এবং গণতন্ত্রের প্রবাহমান স্রোতকে একটি বিশেষ স্তরে পৌঁছে দেওয়ার দিকেও প্রভাব ফেলে।
প্রতিনিধিত্বমূলক ফটো
সংবাদমাধ্যম এবং সাংবাদিকতার দায়িত্ব এমন প্রেক্ষাপটে আরও মননশীল হয়ে উঠেছে। ভারতের মতো বহু ভাষাভাষী, সাংস্কৃতিক এবং আধ্যাত্মিকভাবে বৈচিত্র্যময় দেশে সংবাদমাধ্যমকে সংবেদনশীল দিকগুলোও বিবেচনায় রাখতে হয়। বিশাল সংখ্যক ডিজিটাল ব্যবহারকারীর কারণে আজকের ভারতে সামাজিক মাধ্যমের প্রভাব আরও গতিশীল হয়েছে।
ডিজিটাল তথ্যপ্রবাহ এবং বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট আজ সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বব্যাপী সংবাদ ও যোগাযোগের পরিবেশ অত্যন্ত দ্রুতগতিতে পরিবর্তিত হচ্ছে। প্রচলিত নিউজ চ্যানেলের পাশাপাশি হাজার হাজার ডিজিটাল চ্যানেল, ব্লগ, ইনফ্লুয়েন্সার এবং কনটেন্ট নির্মাতারা যে কোনো খবর মুহূর্তের মধ্যে প্রচার করার সুবিধা পাচ্ছেন। যেভাবে মানুষ আরও সহজে নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারছে, তার বিপরীতে সত্য সংবাদে ভরসা কতটা, সে বিষয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
প্রতিনিধিত্বমূলক ফটো
অনেক সময় রাজনৈতিক বা মতাদর্শগত উদ্দেশ্যে সংগঠিতভাবে মিথ্যা তথ্য প্রচারে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর ফলে সংবাদমাধ্যমকে আজ নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা ধরে রাখার জন্য একটি ধরনের ‘যুদ্ধ’ চালাতে হচ্ছে। ভারতের মিডিয়া আজ এত বড় সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে, যা এক আশাপ্রদ বিষয়। কিন্তু ডিজিটাল মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের অভাবের কারণে মিথ্যা খবর অনেক সময় মানুষের আবেগকে উত্তেজনার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সত্য ছবি বা ভিডিও অন্য প্রেক্ষাপটে শেয়ার করে বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা ও দেখা যাচ্ছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তৈরি ভিডিও বা অডিওর প্রচার ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভুল তথ্য বেশি প্রচারিত হলে সংবাদমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা নিতান্তই স্বাভাবিক। সংবাদমাধ্যম জনমুখী সেবার এক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। আজকের উত্তরণমুখী বিশ্বকে নতুন পর্যায়ে নিয়ে যেতে সংবাদমাধ্যমকেই অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে, এতে কোনো দ্বিমত নেই।
প্রতিনিধিত্বমূলক ফটো
সংবাদমাধ্যমের ভুল তথ্য প্রায়শই বিভ্রান্তির উদ্রেকের উদাহরণ হয়ে থাকে। ১৯৯০ সালে নাইরাহর সাক্ষাৎ ঘটনাটি গালফ যুদ্ধকে প্রভাবিত করেছিল। নাইরাহ নামের একজন কুয়েতের কিশোরী মার্কিন কংগ্রেসে সাক্ষ্য দেন যে এক সেনা কুয়েতের শিশু রোগীদের বিছানা থেকে তুলে হত্যা করছে। এই খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পায় এবং বিশ্বজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। পরে এটি মিথ্যা প্রমাণিত হয়। তবে এই ঘটনাটি গালফ যুদ্ধে আমেরিকার অংশগ্রহণের জন্য জনসমর্থন বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
১৮৩৫ সালে দ্য নিউ ইয়র্ক চ্যান সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় যে জন হারচেল নামের একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী চাঁদে বাদুড় সদৃশ মানুষ বা প্রাণী খুঁজে পেয়েছেন। এই খবর সংবাদপত্রের চাহিদা বাড়িয়েছিল, যদিও পরে এটি ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়। ২০০২ সালে বহু সংবাদমাধ্যম প্রকাশ করেছিল যে ইরাক বিধ্বংসী অস্ত্র সংরক্ষণ করছে। ইরাকে প্রবেশের পর আমেরিকা তেমন কোনো অস্ত্র খুঁজে পাননি। তবে এই ভুল তথ্যই ইরাক যুদ্ধের জনসমর্থন বৃদ্ধি করতে সাহায্য করেছিল।
প্রতিনিধিত্বমূলক ফটো
১৮৯৮ সালে ভুল তথ্যের কারণে স্পেন ও আমেরিকার মধ্যে যুদ্ধ হয়। সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছিল যে স্পেন হাভানা বন্দরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি জাহাজ বোমা দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে। পরে প্রমাণিত হয় যে জাহাজটি যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল। এই ভুল তথ্য আমেরিকাকে যুদ্ধের পথে ঠেলে দেয়।
১৯০০ সালে ‘প্রটোকলস অব দ্য এল্ডার্স অব জায়ন’ নামের একটি জাল নথি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পায়। এতে বলা হয়েছিল যে ইহুদিরা বিশ্ব দখলের ষড়যন্ত্র করছে। পরে এটি মিথ্যা প্রমাণিত হয়, যদিও বহু দশক ধরে এটি বিশ্বজুড়ে ইহুদি বিরোধী মনোভাবকে জাগিয়ে রেখেছিল।
এমন ভুয়া ও কল্পিত তথ্য সমাজ এবং দেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই সংবাদমাধ্যমকে তার বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখতে সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন। এর জন্য কঠোর ফ্যাক্ট চেকিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা আবশ্যক। অনুসন্ধানমূলক সাংবাদিকতাকে প্রাধান্য দেওয়ার চেষ্টা চালানো উচিত। এছাড়াও, সামাজিক মিডিয়ায় ভুল খবর প্রকাশিত হলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া অপরিহার্য।
প্রতিনিধিত্বমূলক ফটো
লাইভ আলোচনী, সম্পাদকীয় প্রশ্নোত্তর, জনমত গ্রহণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিশ্বাসযোগ্যতা গড়ে তোলা সম্ভব। নাগরিকদের যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত, সামাজিক সৌহার্দ্য এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য বিশ্বাসযোগ্য সংবাদ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ডিজিটাল যুগের চ্যালেঞ্জগুলো সাংবাদিকদের দায়িত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখা মানে শুধুমাত্র সঠিক সংবাদ দেওয়া নয়, এটি স্বচ্ছতা, নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ বজায় রাখতেও সহায়ক।
গণমাধ্যম গণতন্ত্রের পৃষ্ঠভূমি। বিশ্বাসযোগ্যতাহীন সংবাদ গণতন্ত্রকে দুর্বল করে। ভুয়া সংবাদ প্রতিরোধ আধুনিক যুগের একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সাংবাদিক মানদণ্ড আরও দৃঢ় করা, মিডিয়া সাক্ষরতা উন্নত করা, প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্মের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, নীতি-আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ করা—এই সব দিকের সমন্বয় ঘটালে একটি কার্যকর ভুয়া সংবাদ প্রতিরোধী ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।
(লেখক একজন সাহিত্যিক। আজকের জাতীয় প্রেস দিবস উপলক্ষে এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে।)