লেখক: মালিক আসগর হাশমি
যখনই দেশের সংসদে বা জনসম্মুখে ‘বন্দে মাতরম’-এর উল্লেখ আসে, তখনই নতুন এক বিতর্ক শুরু হয়। একদিকে ধর্মীয় সংগঠনগুলো এটি ইসলামি বিশ্বাসের বিরুদ্ধে দাবি করে বিরোধ দেখায়, অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল এটিকে জাতীয়তাবাদ ও দেশভক্তির প্রতীক হিসেবে সমর্থন করে। এই উত্তপ্ত বিতর্কের মধ্যে এমন একটি কণ্ঠ রয়েছে যা ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উভয় দিক থেকে আলাদা—এটি হলো বিখ্যাত গীতিকার ও লেখক জাভেদ আখতারের কণ্ঠ।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন লোকসভায় ‘বন্দে মাতরম’-এর পক্ষে কথা বলেছেন, তখন এই বিষয়টি আবার আলোচনায় এসেছে। এবার সোশ্যাল মিডিয়ায় জাভেদ আখতার-এর বহু বছরের পুরনো বক্তব্যও ভাইরাল হচ্ছে। বন্দে মাতরম নিয়ে জাভেদ আখতার-এর মতামত মৌলানারা বা প্রথাগত ইসলামি পণ্ডিতদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তার স্পষ্ট বিশ্বাস, এই বিতর্ক ইতিমধ্যেই পুরনো এবং এটি অযথা বাড়ানো হচ্ছে।
জাভেদ আখতার-এর মূল যুক্তি: এটি একটি ‘অপ্রয়োজনীয় বিষয়’
জাভেদ আখতার পুরো বিতর্কটিকে ‘নন-ইস্যু’, অর্থাৎ একটি অপ্রয়োজনীয় এবং অযথা উত্তেজিত করা বিষয় মনে করেন। তার সরাসরি এবং কঠোর যুক্তি হলো—যাদের এই গানে আপত্তি আছে, তারা এটি গাইবে না। কারও উপর জোরজবরদস্তি করা হচ্ছে না। আখতার বলেন,“আপনি বন্দে মাতরম গাইতে চান না, তাহলে গাইবেন না! কে আপনাকে বাধ্য করছে? আমি গাই। আমার মনে হয় না এটি নিয়ে আপত্তি করার কিছু আছে। যদি আপনি আপত্তি করেন, তবে গাইবেন না। তাহলে কেন অপ্রয়োজনীয় বিষয়গুলিকে বিতর্কের মধ্যে টেনে আনছেন?”
এই অবস্থান তাকে জমিয়ত উলামা-এ-হিন্দ এর নেতা মৌলানা আরশাদ মাদানির মতো নেতাদের থেকে সরাসরি আলাদা করে। মৌলানা মাদানি বিরোধটি সম্পূর্ণ ধর্মীয় তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে করেন। তার যুক্তি, ‘বন্দে মাতরম’-এর অর্থ মূলত “মা, আমি আপনাকে পূজা করি,” এবং যেহেতু ইসলাম একেশ্বরবাদ (তৌহিদ)-এ বিশ্বাস রাখে, তাই একজন মুসলিম আল্লাহ ছাড়া অন্য কারও পূজা বা ইবাদত করতে পারে না। তার জন্য এই গানটি দেশকে দেবীর রূপে উপস্থাপন করে, যা তার ধর্মীয় বিশ্বাসের বিপরীত।
এদিকে, জাভেদ আখতার বন্দে মাতরমকে ধর্মীয় নয়, বরং সাংস্কৃতিক/জাতীয় প্রকাশ হিসেবে দেখেন। তিনি এটিকে ধর্মীয় উগ্রপন্থা থেকে আলাদা মনে করেন, যার ভয়ে কিছু মানুষ বিরোধ করে। তার মতে, এই লাইনটি দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের অনুভূতি প্রকাশের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে, কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান জন্য নয়। এজন্যই তিনি নিজের লেখা ও সিনেমার গানগুলোতে এই লাইন ব্যবহারে দ্বিধা করেননি। তিনি প্রিয়দর্শন-এর ‘সাজা-এ-কালা পানী’ এবং শাহরুখ খান-এর ‘ফিরওই দিল হ্যি হিন্দুস্তানি’ সিনেমার গানগুলোতে ‘বন্দে মাতরম’ ব্যবহার করেছেন, যা দেখায় তিনি এটিকে সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
ইতিহাসের বাস্তবতা ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার
জাভেদ আখতার বন্দে মাতরমের বিতর্কিত ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট স্বীকার করেন, তবে আজকের জাতীয় প্রতীক হিসেবে এর গুরুত্ব কম করেন না। তিনি মনে করেন, গানটি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘আনন্দমঠ’-এর অংশ, যেখানে সব খলনায়ক মুসলিম। উপন্যাসের শেষে মুসলিমদের পরাজয় হয় এবং লেখক খুশি হন যে ব্রিটিশরা তাদের ‘বর্বর’ মুসলিমদের হাত থেকে রক্ষা করেছে।
তবে, আখতার যুক্তি দেন, গানটি তার উৎসকে ছাড়িয়ে গেছে। তিনি মনে করান, যখন গানটি জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে তৈরি করার কথা উঠেছিল, তখন কংগ্রেস যুক্তিসঙ্গত আপত্তিগুলি শুনেছিল। কংগ্রেস দুইটি “ধর্মীয় কট্টর” স্তবক বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, ফলে বিতর্ক শেষ হয়। আখতার মনে করেন, নতুন বিরোধ শুধু ‘বাজে’। তিনি জোর দিয়ে বলেন, এই গান ভারতীয় উত্তরাধিকার্যের একটি বিশেষ অংশ হয়ে গেছে এবং এটি ধর্মীয় লিটারমাস টেস্ট হিসেবে দেখা উচিত নয়।
মৌলানাদের যুক্তি আজও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। তারা মনে করেন, উপন্যাসের মুসলিম-বিরোধী ভাব এবং দেবী দুর্গার ইমেজ, যদিও স্তবক বাদ দেওয়া হয়েছে, গানকে ধর্মীয় করে তোলে। কিন্তু আখতার মনে করেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গান বা নারা অর্থ পরিবর্তন হয় এবং এর ব্যাপক জাতীয় আবেদন ধর্মীয় উগ্রপন্থার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়।
জোরজবরদস্তির বিরুদ্ধে: দেশভক্তির পরীক্ষা বিরোধ
জাভেদ আখতার-এর দৃষ্টিকোণ একটি গুরুত্বপূর্ণ উদারপন্থী পার্থক্য রাখে—যেখানে তিনি গানকে সমর্থন করেন, সেখানে তিনি দেশভক্তির নামে কারও ওপর এটি চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে। তিনি সমর্থন করেছেন সেই প্রকাশ্য বক্তব্যগুলিকে, যেখানে গানকে দেশভক্তির পরীক্ষা হিসেবে চাপানোর চেষ্টা বিরোধ করা হয়েছে। আখতার এটিকে “বিভাজনকারী মানুষদের একটি কৌশল” মনে করেন।
অর্থাৎ, আখতার-এর অবস্থান দুই ভাগে বিভক্ত:
সাংস্কৃতিক স্বীকৃতি: আমি এটি গাই, আমি এটি ব্যবহার করি, এটি আমাদের উত্তরাধিকার।রাজনৈতিক বিরোধ: এটি জোর করে গাওয়া ভুল, কারণ এটি ভারতের গণতান্ত্রিক ও বহুত্ববাদী মূল্যের বিরুদ্ধে।
এই দ্বৈত অবস্থান তাকে সেই রাজনৈতিক চাপ থেকেও রক্ষা করে, যা প্রত্যেক নাগরিককে দেশের প্রতি ভালোবাসা প্রমাণের জন্য কোনো জাতীয় প্রতীক গ্রহণ করতে বাধ্য করে। আখতার, যিনি নিজেকে নাস্তিক বলেন, স্পষ্টভাবে ধর্মীয় ও জাতীয় প্রতীকগুলোর রাজনৈতিক অপব্যবহারের বিরুদ্ধে, যদিও ব্যক্তিগতভাবে তিনি এগুলো সাংস্কৃতিকভাবে গ্রহণ করেন।
জাভেদ আখতার বন্দে মাতরমকে শুধুমাত্র একটি আবেগী ঝগড়া মনে করেন না; বরং তিনি এটিকে রাজনৈতিকভাবে প্ররোচিত এবং অর্থহীন মনে করেন। তার দৃষ্টিকোণ যুক্তিসঙ্গততা, সাংস্কৃতিক অন্তর্ভুক্তি এবং সংবিধান দ্বারা প্রদত্ত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর জোর দেয়। তিনি ভারতের বহুত্ববাদী সমাজে শান্তি বজায় রাখতে ধর্মীয় বিতর্ককে কেন্দ্রবিন্দুতে আনার বিরুদ্ধে।
সংক্ষেপে, আখতার-এর বার্তা স্পষ্ট: দেশের প্রতি ভালোবাসা প্রমাণ করার জন্য কোনো গান গাওয়ার প্রয়োজন নেই, এবং এই গানকে জোর করে চাপিয়ে অযথা ধর্মীয় বিদ্বেষ তৈরি করা উচিত নয়।