গুগলে ভারতের সন্ধান: ২০২৫ সালে ভারতীয়রা কী কী খুঁজল?

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 6 d ago
প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি
 
মালিক আসগর হাশমি

প্রায় ১.৫ বিলিয়ন জনসংখ্যার দেশ ভারত বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল ইন্টারনেট–ব্যবহারকারী দেশগুলির অন্যতম। দিল্লির ব্যস্ত নগরজীবন থেকে শুরু করে রাজস্থানের মরুভূমি কিংবা আসামের সবুজ প্রকৃতি, দেশের প্রতিটি প্রান্তের সব বয়সের মানুষই গুগলে কিছু না কিছু খোঁজে। আর এই অনুসন্ধানের তালিকাই বলে দেয়, ২০২৫ সালে ভারত কোন বিষয় নিয়ে সবচেয়ে বেশি কৌতূহলী ছিল, কোন বিষয় মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে, আর কোন বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তা বেড়েছে। গুগলের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন "সন্ধানের বর্ষ: A- র থেকে Z ট্রেন্ডিং ২০২৫"–এ সারা বছরের ডিজিটেল ভারতের মানসিকতার স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে।
 
প্রথমে আসা যাক মনোরঞ্জন নিয়ে, কারণ ভারত ও বিনোদনের সম্পর্ক সবসময়ই গভীর। এ বছর যে সিনেমাটি মানুষের মনে যেমন ছাপ ফেলেছে, তেমনি গুগল-সার্চেও রাজত্ব করেছে, তা হলো “ছায়ারা”। অনিত পাড্ডা ও আহান পান্ডের এই ছবি মুক্তি পাওয়ার পরই এর গান, কাহিনি-সহ সবকিছুই মানুষ ব্যাপকভাবে খুঁজেছে। ছবির টাইটেল-ট্র্যাকটি গুগলে সবচেয়ে বেশি অনুসন্ধান করা গানগুলির মধ্যে ছিল।দক্ষিণ ভারতীয় ছবিগুলিও এবার ব্যতিক্রমী সাফল্য দেখিয়েছে। কান্তারা: এ লেজেন্ড চ্যাপ্টার ১, কুলি, এবং মার্কোর মতো ছবির প্রতিও মানুষের আগ্রহ ছিল তীব্র। স্পষ্ট বোঝা যায়, ভাষা নয়, ভালো কনটেন্টই হলো আজকের দর্শকের সত্যিকারের স্টার।
 
কিন্তু মনোরঞ্জনের থেকেও বেশি যে বিষয় ভারতকে মুগ্ধ করেছে, তা হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), বিশেষ করে গুগলের নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম Gemini, যা IPL-এর পর ভারতের দ্বিতীয় সর্বাধিক সার্চ-করা বিষয় হয়েছে। এছাড়া DeepSeek, Perplexity, ChatGPT, Google AI Studio এবং Flow-এর মতো প্ল্যাটফর্মও সার্চ-ট্রেন্ডে উজ্জ্বল ছিল। এতে নিশ্চিত হওয়া যায়, ভারত এখন প্রযুক্তিকে শুধু ‘স্বাগত’ই জানাচ্ছে না, বরং নতুন শক্তি হিসেবে গ্রহণ করছে।
 
২০২৫ সালে ইন্টারনেটে সর্বাধিক  সার্চ করা বিষয়সমূহের একটি ছবি
 
এবার আসা যাক ক্রীড়া নিয়ে। ভারতের প্রথম প্রেম কী, এ প্রশ্নের উত্তর আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই। ২০২৫ সালেও IPL ইন্টারনেট-জগতের রাজা হয়ে রইল। কিন্তু এ বছর এক নতুন বিষয় চোখে পড়েছে, মহিলা ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহের তীব্র বৃদ্ধি। বিশ্বকাপজয়ী জেমিমা রোড্রিংস সারাদেশে সর্বাধিক খোঁজা ক্রীড়াবিদদের মধ্যে ছিলেন। এ দৃশ্য ভারতীয় সমাজের পরিবর্তনের সুন্দর প্রতিফলন, যেখানে খেলাধুলা আর শুধু পুরুষ-মহলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই।
 
এ বছরের জাতীয় ঘটনাগুলিও গুগল-সার্চকে প্রভাবিত করেছে। কিংবদন্তি অভিনেতা ধর্মেন্দ্র-র মৃত্যুর পর লাখো মানুষ তাঁর জীবন, ছবি ও সাক্ষাৎকার খুঁজেছেন। তেমনই মহাকুম্ভ ২০২৫-ও ব্যাপক সার্চ-ট্রাফিক তৈরি করেছে, কোথায় থাকা উচিত, ভিড় কীভাবে এড়ানো যায়, যানজট কেমন হবে, স্নানের সময়সূচি, এ রকম অসংখ্য প্রশ্নে মানুষ গুগল ভরিয়ে তুলেছে।
 
আরও একটি আকর্ষণীয় অনুসন্ধান ছিল, "আমার আশেপাশে ভূমিকম্প"। ২০২৫-এ এটি ছিল ‘Near Me’ ক্যাটেগরির শীর্ষে। মানুষ বায়ুর গুণমান, হাসপাতাল, ওষুধের দোকান, সিনেমা হল, সবকিছুই খুঁজেছে, কিন্তু সবচেয়ে বেশি চিন্তিত ছিল ভূমিকম্প নিয়ে। স্পষ্ট বোঝা যায় যে প্রযুক্তি মানুষকে আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন করে তুলছে।
 
সোশ্যাল মিডিয়ার উন্মাদনায় জন্ম নেওয়া আরেক ট্রেন্ড ছিল ‘লাবুবু খেলনা’। ‘#67m’ মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যায় এবং এর সার্চ আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে। ইন্টারনেট সত্যিই অদ্ভুত, একটি ছোট ঘটনা রাতারাতি খবরের শিরোনাম দখল করতে পারে। ভারতীয় খাবারও এ বছর গুগলে ব্যাপক সার্চ পেয়েছে। মানুষ খুঁজেছে, ‘থেকুয়া’, ‘উক্রিচে মোদক’, এমনকি ‘ইয়র্কশায়ার পুডিং’-এর মতো বিদেশি খাবারের বিষয়েও। এতে বোঝা যায়, ভারতের স্বাদ-অন্বেষণে এখন দেশি-বিদেশি দুই-ই জায়গা করে নিয়েছে।
 
২০২৫ সালে ইন্টারনেট অনুসন্ধানের ট্রেন্ডে থাকা বিষয়গুলির একটি ছবি
 
স্কুইড গেম-এর মতো জনপ্রিয় আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানও আবার ভারতীয়দের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে।মহাকাশচারী সুনীতা উইলিয়ামস, ক্রিকেটার বৈভব সূর্যবংশী, এঁরাও সার্চ–ট্রেন্ডে জায়গা পেয়েছেন। কিন্তু সার্চ-তালিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, ভারতীয় মননের পরিবর্তন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রফেসর রাজগোপাল ধর চক্রবর্তী বলেন, “গুগলের সার্চ সাধারণ মানুষের মানসিকতাকে উন্মুক্ত করে।”
 
উদাহরণস্বরূপ, এ বছর ‘যুদ্ধবিরতি’ শব্দটি হঠাৎ ব্যাপকভাবে ট্রেন্ডে ওঠে। মানুষ শব্দের অর্থই নয়, এর ব্যবহার, এর প্রেক্ষাপট-সবই জানতে চেয়েছে। এটি প্রমাণ করে-শান্তি, আলোচনা ও কূটনীতি সম্পর্কে ভারত আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। তেমনই ওয়াকফ আইন-ও বৃহৎ অনুসন্ধানের বিষয় ছিল, মানুষ জানতে চেয়েছে এই আইন তাঁদের স্বার্থ রক্ষা করে কিনা, উন্নয়নে সাহায্য করে কিনা, এটাই ডিজিটেল যুগের নতুন ভারতের পরিচয়।
 
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বাড়তে থাকা প্রভাব নিয়ে বিশেষজ্ঞরাও সতর্ক করেছেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনমুন ভট্টাচার্য বলেন, ছাত্র-ছাত্রীরা AI-কে শর্টকাট হিসেবে ব্যবহার করছে, ফলে জ্ঞানের ব্যবধান বাড়ছে। অন্যদিকে সাইবার-সিকিয়োরিটি বিশেষজ্ঞ সন্দীপ সেনগুপ্ত সতর্ক করেছেন যে আগামী দিনে বহু চাকরি AI-এর কারণে হারিয়ে যেতে পারে এবং ডিপফেক সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
 
২০২৫ সালের গুগল-সার্চ-ট্রেন্ড ভারতের ভাবনার এক উজ্জ্বল, আকর্ষণীয় এবং কখনও কখনও বিস্ময়কর প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে, যেখানে প্রযুক্তি, বিনোদন ও জ্ঞানের মধ্যে ভারসাম্য রেখে দেশ এগিয়ে চলেছে; যেখানে কৌতূহল লুকানো হয় না, বরং উন্মুক্ত ইন্টারনেটের সাহায্যে উত্তর খোঁজা হয়; আর যেখানে নতুন পৃথিবীর সামনে দাঁড়িয়ে ভারত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এগিয়ে চলেছে।