মুসলিম কারিগরদের হাতে তৈরি বাজি, হিন্দুদের উৎসবে বন্ধুত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বঙ্গের নানা জেলায়

Story by  Debkishor Chakraborty | Posted by  Sudip sharma chowdhury • 7 d ago
হুগলির একটি বাজি তৈরীর কারখানায় কর্মরত কারিগররা
হুগলির একটি বাজি তৈরীর কারখানায় কর্মরত কারিগররা
 
দেবকিশোর চক্রবর্তী 

পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ অঞ্চলগুলোতে কালীপুজো ও দীপাবলি মানেই বাজির কিলকিল শব্দ আর উচ্ছ্বাসের হাহাকার। এই আনন্দের পেছনে থাকে গেরস্থালি কারিগরদের পরিশ্রম, যারা বছরের প্রায় ৮–১০ মাস বাজি তৈরিতে ব্যস্ত থাকেন। আশ্চর্যের বিষয়, এই শিল্পের মূল চালিকাশক্তি হলো মুসলিম সম্প্রদায়ের কারিগররা।

উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হুগলি, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ—এই অঞ্চলের গ্রামগুলোতে বাজি তৈরির এক দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। ব্রিটিশ শাসনামলে শুরু হওয়া এই শিল্পে প্রথমে হিন্দু সম্প্রদায় যুক্ত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে মুসলিম কারিগররা যোগ দিয়ে এটিকে সমৃদ্ধ করেন। বিশেষ করে হুগলির চুঁচুড়া, শ্রীরামপুর, আরামবাগ এবং মুর্শিদাবাদের বহরমপুর ও রাণীনগর আজকের দিনে বাজি শিল্পের প্রধান কেন্দ্র।

কারিগররা পটকা, চক্র, রকেট, আতশবাজি ও মোমবাতি তৈরি করেন। তাদের অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করে যে, বাজি নিরাপদ ও মানসম্পন্ন হয়। স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এই বাজি রপ্তানি হয়। পরিবারের প্রজন্মগুলো একে পরম্পরায় শিখে চলে, যা শিল্পটিকে যুগে যুগে সমৃদ্ধ করছে।

কালীপুজো ও দীপাবলি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রধান উৎসব। এই সময়ে বাজি ফাটানো হয় উৎসবের আনন্দকে বহুগুণ বাড়াতে। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষরা মুসলিম কারিগরদের তৈরি বাজি দিয়ে এই আনন্দ উদযাপন করেন। এমন দৃশ্য প্রমাণ করে যে ধর্মীয় পার্থক্য থাকলেও উৎসবে একে অপরকে সমর্থন করা যায়। এটি সমাজে বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বের এক উজ্জ্বল নিদর্শন।

বাজি শিল্পে হিন্দু-মুসলিম সহযোগিতা পশ্চিমবঙ্গের সামাজিক সম্প্রীতির প্রতীক। ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে একে অপরের উৎসবে অংশগ্রহণ শান্তি ও সহনশীলতার বার্তা দেয়। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় এই সহযোগিতা স্থানীয় সমাজে স্থিতিশীলতা ও পারস্পরিক সমঝোতার পরিবেশ সৃষ্টি করে।

তবে শিল্পের সঙ্গে কিছু চ্যালেঞ্জও জড়িত। বাজির অতিরিক্ত শব্দ এবং রাসায়নিক ব্যবহারের কারণে পরিবেশ দূষণ বেড়েছে। পরিবেশবান্ধব বাজি তৈরির উদ্যোগ নেওয়া এখন সময়ের দাবি। সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসন ও সমাজকে মিলিতভাবে কাজ করতে হবে যাতে এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধবভাবে পরিচালিত হয়।

মুসলিম কারিগরদের দক্ষ হাতে তৈরি বাজি শুধু অর্থনৈতিক কল্যাণই দেয় না, বরং সমাজে বন্ধুত্ব ও সম্প্রীতির বার্তাও পৌঁছে দেয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের উৎসবকে আরও উজ্জ্বল করে তোলার মাধ্যমে এটি বন্ধুত্বের এক অনন্য নিদর্শন।

পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ এলাকায় এই বাজি শিল্প প্রমাণ করে যে, ধর্মীয় পার্থক্য ভুলেও মানুষ একে অপরের উৎসবকে সমর্থন করতে পারে। হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মিলিত প্রচেষ্টা সমাজে শান্তি, ঐক্য এবং মানবিক বন্ধনের শক্তিশালী বার্তা পৌঁছে দেয়। উৎসবের আনন্দ কেবল মনোরঞ্জন নয়, বরং সামাজিক বন্ধুত্ব ও সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল প্রতীক।