শিশুদের মধ্যে শ্বাসযন্ত্রের জটিল রোগের চিকিৎসায় একটি নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে। যে চিকিৎসা আগে অসমে উপলব্ধ ছিল না এবং যার জন্য শিশুদের অন্য রাজ্যে নিয়ে যেতে হয়েছিল। আজকাল,শিশুদের এই রোগের চিকিৎসা করা খুব সহজ। প্রখ্যাত শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ ইয়াসিন আলী অসম এবং উত্তর-পূর্বে প্রথমবারের মতো ব্রঙ্কোস্কোপি আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা প্রদানের মাধ্যমে অসমে চিকিৎসার ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায় শুরু করেছেন।
সম্প্রতি,গুয়াহাটির খানাপাড়ার হেলথ সিটি হাসপাতালের প্রধান শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ ইয়াসিনের নেতৃত্বে অভিজ্ঞ শিশুরোগ বিশেষজ্ঞদের একটি দল এই ব্রঙ্কোস্কোপি কৌশল দিয়ে নাগাল্যান্ডের আড়াই মাসের একটি শিশুর চিকিৎসা করেছে এবং শিশুটি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।
দিল্লির গুরগাঁওয়ের ফোর্টিস মেমোরিয়াল রিসার্চ ইনস্টিটিউটে ইন্ডিয়ান একাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্সের ব্রঙ্কোস্কোপি কোর্স সম্পন্ন প্রার্থীদের সাথে ডাঃ ইয়াসিন আলী
ব্রঙ্কোস্কোপি হল একটি প্রক্রিয়া যেখানে ব্রঙ্কিয়াল টিউবগুলিতে একটি ছোট টিউব ঢোকানো হয়। নবজাত শিশুর ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিটি খুব চ্যালেঞ্জিং, কারণ নবজাতকের শ্বাসযন্ত্রের ট্র্যাক্ট খুব সূক্ষ্ম, তাই এর ভিতরে যন্ত্রটি প্রবেশ করানোর ফলে তাদের শরীরে অক্সিজেনের পরিমাণ দ্রুত হ্রাস পায়। কারণ নবজাতকদের এই ধরনের চিকিৎসার জন্য সূক্ষ্ম যন্ত্রের অভাব ছিল। তবে, নতুন চিকিৎসা প্রযুক্তি এবং ছোট যন্ত্রপাতির আবির্ভাবের ফলে শিশুদের জীবন বাঁচানো সহজ হয়ে উঠেছে। নতুন উদ্ভাবিত ডিভাইসগুলির সাহায্যে শিশুদের জীবন বাঁচানো এখন সম্ভব যা ২ মিমি এবং ৩ মিমি চুলের চেয়েও সূক্ষ্ম। এই চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে নবজাতক থেকে প্রাপ্তবয়স্কদের ৮০০ গ্রাম দেওয়া হচ্ছে। এই পাইপের আকার সাধারণত প্রাপ্তবয়স্ক রোগীদের মধ্যে ১৫-১৬ মিমি। যা নবজাতকের ক্ষেত্রে কার্যকরী নয়।
ডাঃ ইয়াসিন আলী বলেন, "অসমে এই জটিল শ্বাসকষ্টের কোনও চিকিৎসা ছিল না। যার কারণে অনেক শিশুকে এই রোগের চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হয়েছিল। যেখানে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়েছিল। আমি প্রায়ই তাদের দেখতে যেতাম এবং এই চিকিৎসার জন্য কিছু করার কথা ভাবতাম। কারণ এই ক্ষেত্রে কাউকে এগিয়ে যেতে হবে না। এই কারণেই আমি ২০২৪ সালে দিল্লির গুরগাঁওয়ের ফোর্টিস মেমোরিয়াল রিসার্চ ইনস্টিটিউটে ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্স দ্বারা আয়োজিত 'ব্রঙ্কোস্কোপি'-র মৌলিক কোর্সটি সফলভাবে সম্পন্ন করেছি এবং এই বছর আমি প্রথমবারের মতো এই কোর্সের অ্যাডভান্সড কোর্সটি সম্পূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছি। এই কোর্সের জন্য, চেন্নাই, মহারাষ্ট্র, পুনে, ওড়িশা, দিল্লি, হরিয়ানা, চণ্ডীগড় ইত্যাদি সহ সারা দেশ থেকে অনেক পেডিয়াট্রিশিয়ান এবং পালমোনোলজিস্ট। আবেদন করেন এবং মাত্র ২০ জন প্রার্থীকে নির্বাচিত করা হয়। এই কোর্সে আমি একটি স্বর্ণপদক জিততে পেরেছি। "
ডাঃ ইয়াসিন আলী একটি নবজাতক শিশুকে পরীক্ষা করার একটি দৃশ্য
আগে শিশুদের এই রোগের চিকিৎসার জন্য বিশেষ কোনো যন্ত্রপাতি পাওয়া যেত না। তখন চিকিৎসা করার জন্য শিশুদের বুক ফেরে শল্যচিকিৎসা করাই বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু গত ৫ থেকে ১০ বছরে এই ক্ষেত্রে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বিকাশ ঘটেছে। বর্তমানে মাত্র ২-৩ মিমি আকারের বিশেষ পাইপ নাকের মাধ্যমে শ্বাসনলীতে প্রবেশ করিয়ে এন্ডোস্কোপি ব্যবহার করে সহজে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা করা যায়।
ডা. ইয়াসিনের কথায়, “আগে এই রোগের চিকিৎসার জন্য শিশুদের ওপেন সার্জারি করতে হতো। তবে আজকের প্রযুক্তির সাহায্যে প্রায় ৯৫ শতাংশ শিশু আমরা শল্যচিকিৎসা ছাড়াই নিরাময় করতে সক্ষম হয়েছি। এখন শিশুরা কোনো ব্যথা বা কষ্ট ছাড়া তাদের নাকের মধ্য দিয়ে শ্বাসনলীতে যেয়ে নানা ধরনের সমস্যা সনাক্ত করা যায় এবং তাৎক্ষণিক চিকিৎসাও করা সম্ভব। পাশাপাশি, অনেক শিশু জন্মগতভাবে শ্বাসনলীর বিভিন্ন অসুবিধা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এই আধুনিক পদ্ধতির মাধ্যমে আমরা লেজার থেরাপি, ক্রায়ো থেরাপি, ক্ষুদ্র অস্ত্রোপচার, স্টেন্ট বসানো, টিউমার নিরীক্ষণ ও শ্বাসনলীতে আটকে থাকা খাবার অপসারণ ইত্যাদি জটিল চিকিৎসা কার্যক্রমও নিরাপদে সম্পন্ন করতে পারি।”
ডাঃ ইয়াসিন আলীর সার্টিফিকেট এবং স্বর্ণপদক গ্রহণ করার একটি ছবি
ডাঃ ইয়াসিন আলী ১৯৯৪ সালে কেকেবিবি গোলাঘাট থেকে স্কুল শেষ করেন এবং ১৯৯৬ সালে শ্রীমন্ত শঙ্কর একাডেমি গুয়াহাটি থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি শিলচর মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস সম্পন্ন করেন। তিনি গুয়াহাটি মেডিকেল কলেজ থেকে শিশু স্বাস্থ্য বিষয়ে ডিপ্লোমা অর্জন করেন। তিনি নতুন দিল্লির এম. এ. এম. সি থেকে এম. ডি (পেডিয়াট্রিক্স) সম্পন্ন করেন। তিনি সোশ্যাল পেডিয়াট্রিক্স পেপার বিভাগে আইএপি দিল্লির বার্ষিক অনুষ্ঠানে ২০১৭ সালের ড. সত্য গুপ্ত পুরস্কারও পেয়েছেন। তিনি ২০১৮ সালে হেলথ সিটি হাসপাতালে যোগ দেন এবং বর্তমানে হেলথ সিটি হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক বিভাগের প্রধান হিসাবে কাজ করছেন।
ডা. ইয়াসিন বলেন, এই চিকিৎসা প্রযুক্তির আরও উন্নতির জন্য হেলথ সিটি হাসপাতালে একটি পূর্ণাঙ্গ ইউনিট খোলার পরিকল্পনা করা হয়েছে। এখন সাধারণ অস্ত্রোপচারের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করে এন্ডোস্কোপির মাধ্যমে শিশুর চিকিৎসা করা সম্ভব হবে। যদিও এই চিকিৎসার খরচ তুলনামূলকভাবে কিছুটা বেশি, তবুও প্রচলিত অস্ত্রোপচারের খরচের চেয়ে কম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, শিশুর জীবন সহজ এবং নিরাপদ হয়ে উঠবে।
একটি শিশুর চিকিৎসা করার দৃশ্য
২০২২ সালে, ডাঃ ইয়াসিন আলী চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি শিশুর মধ্যে তিনটি বিরল রোগ চিহ্নিত করেন। ১২ মাস ধরে ক্রমাগত গবেষণার পর, ডাঃ আলী একটি শিশুর শরীরে হর্স শু কিডনি(Horse Shoe Kidney), প্রাইমারি সিলিয়ারি ডাইকিনেসিয়া (Primary Ciliary Dykinesia)এবং নোনানস সিনড্রোম(Nonaan's Syndrome) নামে একটি বিরল রোগ সনাক্ত করেন।
এই উদ্ভাবনী ব্রঙ্কোস্কোপি চিকিৎসা প্রযুক্তি অসমের পেডিয়াট্রিক্সের ইতিহাসে একটি সুবর্ণ অধ্যায় হিসাবে রয়ে যাবে। যেহেতু এই চিকিৎসা আগে শুধুমাত্র দিল্লি,চেন্নাই বা অন্যান্য উন্নত চিকিৎসা কেন্দ্রগুলিতে সম্ভব ছিল,এখন এটি অসমে সহজেই পাওয়া যাবে। শিশুদের জীবন বাঁচানোর ক্ষেত্রে এটি একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।