‘মুসলমানির গল্প’: গোবরডাঙ্গা নাবিক নাট্যমের মঞ্চে ধর্ম-সম্প্রীতির অনন্য বার্তা

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 23 d ago
‘মুসলমানির গল্প’: গোবরডাঙ্গা নাবিক নাট্যমের মঞ্চে ধর্ম-সম্প্রীতির অনন্য বার্তা
‘মুসলমানির গল্প’: গোবরডাঙ্গা নাবিক নাট্যমের মঞ্চে ধর্ম-সম্প্রীতির অনন্য বার্তা
 
শম্পি চক্রবর্তী পুরকায়স্থ 

গোবরডাঙ্গা নাবিক নাট্যমের সর্বশেষ প্রযোজনা “মুসলমানির গল্প” যেন আজকের সময়ের আয়না। ধর্ম, মানবতা আর ঐক্যের প্রশ্নে যখন সমাজ বারবার বিভাজনের মুখে দাঁড়িয়ে, তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কালজয়ী গল্পটিকে কেন্দ্র করে পরিচালক জীবন অধিকারী গড়ে তুলেছেন এক গভীর মানবিক নাট্যভাষ্য। শিশু ও কিশোর শিল্পীদের নিয়ে তৈরি এই প্রযোজনা শুধু একটি গল্পের নাট্যরূপ নয়, এটি এক শিক্ষা, যেখানে শিল্পের মাধ্যমে গেঁথে তোলা হয়েছে সহাবস্থানের স্বপ্ন।
 
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মাত্র দু’দিনে, ১৯৪১ সালের ২৪ ও ২৫ জুন, এই গল্পটি লিখে ফেলেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ সময়, গোটা ভারতবর্ষ তখন ব্রিটিশ শাসনের অধীনে, আর স্বাধীনতা সংগ্রাম চরম পর্যায়ে। সেই অস্থির রাজনৈতিক আবহে কবিগুরু দেখেছিলেন এক ভিন্ন বিপদ, দেশের হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদের বীজ। সেই আশঙ্কার প্রেক্ষিতেই জন্ম নেয় “মুসলমানির গল্প” যেখানে ধর্ম নয়, মানবতাই প্রধান সেতুবন্ধন।
 
জীবন অধিকারীর নির্দেশনায় গোবরডাঙ্গা নাবিক নাট্যমের এই নতুন প্রযোজনা সেই রবীন্দ্র-চেতনার পুনর্পাঠ। শিশু ও কিশোর শিল্পীদের অংশগ্রহণেই নাটকটি পেয়েছে এক নির্মল সতেজতা। রনি, ঋজু, রাজেশ, রুমকি, ঋষিতা, নীল, ঐশীনী, অনিরুদ্ধ, বর্ষা, ঈপ্সিতা, পাপিয়া এবং দাদাঠাকুর চরিত্রে অবিন দত্ত, সকলের অভিনয়ে ফুটে উঠেছে এক সংবেদনশীল মানবিক জগত। তাদের নিষ্ঠা ও আন্তরিকতায় দর্শকরা যেন নতুন করে দেখলেন রবীন্দ্রনাথের গল্পের প্রাণস্পন্দন।
 
নাটকের বিভিন্ন মূহুর্তের ছবি
 
নাটকের মঞ্চায়নে আলো, সঙ্গীত ও নৃত্যের ব্যবহারে ফুটে উঠেছে শিল্পনৈপুণ্য। আলো পরিকল্পনায় ছিলেন অশোক বিশ্বাস, আবহসঙ্গীত রচনা করেছেন আস্তিক মজুমদার, আর সেই সঙ্গীতের প্রয়োগে জাদু সৃষ্টি করেছেন সুপর্ণা সাধুখাঁ। পোশাক পরিকল্পনা করেছেন শ্রাবণী সাহা, রূপসজ্জায় শর্মিষ্ঠা সাধুখাঁ এবং নৃত্য পরিকল্পনায় ছিলেন রাখি বিশ্বাস। সমগ্র নাটক জুড়ে নাচ, গান, আবহ এবং আলোর সংমিশ্রণ দর্শকদের নিয়ে গেছে এক আবেগঘন যাত্রায়।
 
নির্দেশক জীবন অধিকারী বলেন, “এই নাটকটি করার মূল উদ্দেশ্য ছিল শিশুদের মনে ধর্ম বা জাতপাতের বিভেদ যেন কোনওভাবেই প্রভাব ফেলতে না পারে। তারা যেন বুঝতে শেখে, মানুষের ধর্ম মানবতা।” তাঁর এই বক্তব্য যেন নাটকের মূল মন্ত্র হয়ে উঠেছে। ছোটদের সহজ সরল অভিনয় ও সংলাপের মধ্যে ফুটে উঠেছে এক গভীর সামাজিক বার্তা, যে ভালোবাসা ও সহমর্মিতাই সমাজকে টিকিয়ে রাখে।
 
প্রদর্শনী শেষে দর্শকদের অভিব্যক্তিও ছিল উৎসাহব্যঞ্জক। এক দর্শক বলেন, “ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা যেভাবে মঞ্চে প্রাণ ঢেলে অভিনয় করল, তাতে মনে হয় থিয়েটারের আগামী প্রজন্ম নিয়ে আমাদের চিন্তা করার কিছু নেই।” সত্যিই, নাটকটি যেন প্রমাণ করে দিল, থিয়েটার শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি সমাজচিন্তার এক জীবন্ত পাঠশালা।
 
গোবরডাঙ্গা নাবিক নাট্যমের এই প্রযোজনার সাফল্য কেবল প্রযুক্তিগত দিক বা অভিনয়ের গুণে নয়, বরং এর ভাবনা ও মানবিকতার গভীরতায়। বর্তমান সময়ে যখন সমাজে ধর্মীয় বিভাজনের ধোঁয়া বারবার ঘনিয়ে আসে, তখন এই নাটক আমাদের মনে করিয়ে দেয় রবীন্দ্রনাথের চিরন্তন বাণী, মানুষের উপরে মানুষ সত্য, ধর্ম তারও উপরে নয়।
 
সবশেষে বলা যায়, “মুসলমানির গল্প” কেবল রবীন্দ্রনাথের গল্পের নাট্যরূপ নয়, এটি এক প্রয়োজনীয় স্মরণ, যে শিশুমনের চোখে আমরা এখনো দেখতে পাই এক অসাম্প্রদায়িক, ভালোবাসায় ভরা আগামী। গোবরডাঙ্গা নাবিক নাট্যমের এই উদ্যোগ সেই আগামী দিনের আশাকে আরও উজ্জ্বল করে তুলল।