বিভাজনের পর পাকিস্তানে সংস্কৃতের পুনরাবিষ্কার: LUMS-এ পূর্ণাঙ্গ কোর্স, গবেষণায় নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 4 d ago
ড. আলি উসমান কাসমি (বামে), ড. শাহিদ রশীদ  (মাঝে) একটি শিক্ষার্থীর সঙ্গে
ড. আলি উসমান কাসমি (বামে), ড. শাহিদ রশীদ (মাঝে) একটি শিক্ষার্থীর সঙ্গে
 
আওয়াজ দ্যা ভয়েস, বাংলা

ইসলামিক রিপাবলিক পাকিস্তানে বিভাজনের পর প্রথমবারের মতো শিক্ষাঙ্গনে নীরবে ফিরে এসেছে সংস্কৃত ভাষা। লাহোর ইউনিভার্সিটি অফ ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সেস (LUMS) সম্প্রতি চালু করেছে সংস্কৃতের একটি পূর্ণ চার-ক্রেডিটের বিশ্ববিদ্যালয় কোর্স। যা শুরু হয়েছিল তিন মাসের সাপ্তাহিক কর্মশালা হিসেবে, তা প্রবল সাড়া পেয়ে ধীরে ধীরে রূপ নেয় নিয়মিত পাঠ্যক্রমে।
 
গুরমানি সেন্টারের পরিচালক ড. আলি উসমান কাসমি 'দ্যা ট্রিবিউন' নামক ইংরাজি সংবাদমাধ্যমকে জানান, পাকিস্তানের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত সংস্কৃত পাণ্ডুলিপিগুলির ভাণ্ডার বিশ্বে অন্যতম সমৃদ্ধ, অথচ বহু দশক ধরে অগবেষিত। তাঁর মন্তব্য “১৯৩০-এর দশকে জেসিআর উলনার হাতে পাম-লিফ পাণ্ডুলিপির তালিকা তৈরি হলেও ১৯৪৭-এর পর কোনো পাকিস্তানি গবেষক আর এসব স্পর্শ করেননি। কেবল বিদেশি গবেষকরাই ব্যবহার করেন। স্থানীয় শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ শুরু হলে এই পরিস্থিতি বদলাবে,”।
 
 লাহোর ইউনিভার্সিটি অফ ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সেস (LUMS)
 
LUMS ভবিষ্যতে মহাভারত ও ভাগবত গীতার ওপরও পাঠ্যক্রম চালুর পরিকল্পনা করেছে। ড. কাসমির আশা, “আরও ১০-১৫ বছরের মধ্যে পাকিস্তান থেকেই উঠে আসতে পারে গীতা-মহাভারতের গবেষক।”
 
শুরুতে সবার জন্য উন্মুক্ত সাপ্তাহিক কর্মশালা চালু করা হয়েছিল, ছাত্রছাত্রী, গবেষক, আইনজীবী, এমনকি শিক্ষকরাও যোগ দিয়েছিলেন। এই বিপুল সাড়া দেখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় এটি নিয়মিত কোর্স হিসেবে চালু করার। ড. কাসমি বলেন “এখনও ছাত্রসংখ্যা খুব বেশি নয়। তবে আগামী কয়েক বছরে ক্রমে বাড়বে বলে আশা। ২০২৭-এর বসন্তেই পুরো বছরের ভাষা কোর্স তৈরি করতে চাই,” ।
 
এই উদ্যোগের কেন্দ্রে আছেন ফরম্যান ক্রিশ্চিয়ান কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শাহিদ রশীদ। তাঁর সংস্কৃতচর্চা শুরু হয়েছিল LUMS তাকে আহ্বান করার বহু আগেই। তিনি বলেন, “ধ্রুপদি ভাষাগুলোর মধ্যে মানবজাতির বহু প্রজ্ঞা লুকিয়ে থাকে। আরবি-ফার্সি শেখার পরই আমি সংস্কৃতে আগ্রহী হই।” স্থানীয় শিক্ষক বা বই না থাকায় তিনি অনলাইনেই শিখেছেন, ক্যামব্রিজের সংস্কৃত পণ্ডিত অ্যান্টোনিয়া রুপেল ও অস্ট্রেলিয়ান ইন্দোলজিস্ট ম্যাককমাস টেলরের কাছ থেকে। “ক্ল্যাসিক্যাল সংস্কৃত ব্যাকরণ আয়ত্ত করতে লেগেছে এক বছর। এখনও পড়ছি,” জানান তিনি।
 
'মহাভারত' এবং 'ভাগবত গীতা'
 
ড. কাসমির ডাক পেয়ে তিনি এফসি কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে LUMS-এ কোর্সটি পড়াতে আসেন। তিনি প্রধানত ব্যাকরণ পড়ান। তিনি জানান “যখন  'সুভাষিত' জ্ঞানময় শ্লোক পড়াচ্ছিলাম, ছাত্ররা অবাক হয়ে দেখল কতগুলো উর্দু শব্দের শিকড় সংস্কৃতে। অনেকেই জানত না সংস্কৃত যে হিন্দির মতো নয়। প্রথম সপ্তাহে কঠিন মনে হলেও ব্যাকরণের যৌক্তিক গঠন বুঝে গেলে তারা উপভোগ করতে শুরু করে,”।
 
ড. রশীদ বলেন, “আধুনিক ভাষাগুলো ধ্রুপদি ধারারই উত্তরসূরি। কেবল একটি পর্দা আমাদের আলাদা করে রেখেছে, একবার এই পর্দাকে সরাতে পারলে, এগুলো সবই আমাদের।”
 
ড. কাসমির মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিষয়ক বৃহত্তর প্রকল্পের সঙ্গেও এই উদ্যোগ জড়িত, সিন্ধি, পশতু, পাঞ্জাবি, বালুচি, আরবি ও ফার্সির মতো ভাষার পাশাপাশি সংস্কৃতও এখানে জায়গা পাচ্ছে। “দক্ষিণ এশিয়ার যৌথ ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযোগের জন্য এটি অপরিহার্য। আমাদের সাহিত্য, দর্শন, শিল্প, সবকিছুই যে বৈদিক যুগের দিকে ফিরে যায়। অনেক ইতিহাসবিদই বলেন, বেদ এই অঞ্চলেই রচিত হয়েছিল। তাই মূল ভাষায় শাস্ত্র পড়া জরুরি।”
 
পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার
 
রাজনৈতিক স্পর্শকাতরতার সত্ত্বেও দুই গবেষকই মানছেন যে পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। ড. রশীদের নিজের সংস্কৃতচর্চা নিয়েও অনেকের কৌতূহল। তিনি বলেন, “মানুষ আমাকে জিজ্ঞেস করে কেন শিখছি। আমি বলি, কেন নয়? এটি গোটা অঞ্চলের বন্ধন-ভাষা। পাণিনির গ্রাম এই অঞ্চলে। সিন্ধু সভ্যতাকালেই এখানে বিপুল সাহিত্য রচিত হয়েছে। সংস্কৃত এক পাহাড়ের মতো, এক সাংস্কৃতিক স্মারক। এটি আমাদেরও।”
 
শেষে ড. রশীদ যোগ করেন, “দক্ষিণ এশিয়ায় ভাষাকে যদি বিভাজনের বদলে সেতু করা যায়? ভারতের হিন্দু-শিখরা যদি বেশি করে আরবি শেখে আর পাকিস্তানের মুসলিমরা যদি সংস্কৃত পড়ে, তবে হয়তো নতুন আশা তৈরি হবে। মিলনের পথ ভাষাই দেখাতে পারে।”