দেবকিশোর চক্রবর্তী / কৃষ্ণনগর
পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাস প্রসিদ্ধ জনপদ নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নামেই শহরের নাম। আর এই শহরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে রসরাজ গোপাল ভাঁড়ের নাম। কয়েক শতাব্দী আগের এই শহরে নেই আজ রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। নেই রাজতন্ত্র। গোপাল ভাঁড়ের আবাস নিয়ে নানা গল্প বাতাসে ওড়ে।
তবে রাজবাড়িতে আজও আছেন রাজা-রানি। দুর্গাপুজোর সপ্তমীর সকালে রাজবাড়ির প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে হলো এক অন্য অভিজ্ঞতা। শারদ উৎসবের এই সময়টাতে জনসাধারণের সামনে আসেন তাঁরা। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির বর্তমান রাজা ও রানি সারা বছর সবার সামনে খুব বেশি না আসলেও পুজোর সময় তাঁদের দেখা যায় বনেদি সাজেই। সেই রীতি মেনেই বর্তমান রাজা সৌমিশ চন্দ্র রায় ও রানি অমৃতা রায় নিজেদের দায়িত্ব পালন করবেন এ বছর।
রাজবাড়ির নবম রাজা সৌমিস চন্দ্র রায় ও রানিমা অমৃতা রায়
পুজোর ক’দিন সাধারণ মানুষ রাজবাড়িতে প্রবেশ করতে পারেন। বছরের বাকি সময় সেই অনুমতি পাওয়া যায় না। পুজো নিয়ে সেজে উঠছে বাংলা। তাই বাদ যাচ্ছে না কৃষ্ণনগর রাজবাড়িও।
রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে গড়ে ওঠে বর্তমান ভবনটি। পুজোর ক’টা দিন কৃষ্ণচন্দ্রের বাড়ি, নদিয়া ও আশেপাশের অঞ্চল পর্যটকদের মূল আকর্ষণ হয়ে ওঠে। এই রাজবাড়িতে দেখার মতো একাধিক নির্দশন থাকলেও দর্শকদের কাছে প্রধান আর্কষন বিরাট পুজো মণ্ডপ। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির মতো বিশালাকার পুজো মণ্ডপ খুব একটা দেখা যায় না। এখানকার বিচিত্র কারুকার্য চোখ ধাঁধিয়ে দেয়।
রাজবাড়ির ভিতরে এখনও পর্যন্ত রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাসদরা যে জায়গায় বসতেন, তা অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। রাজার খাওয়ার জায়গা আজও একই ভাবে ব্যবহৃত হয়। যেহেতু এই বাড়িতেই রাজার বর্তমান উত্তরসূরিদের বাস, তাই সব সময় জনসাধারণকে এখানে ঢুকতে দেওয়া হয় না।
রাজ রাজেশ্বরী মাকে পাটে তোলার মুহূর্ত
কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে সাধারণত সব পুজোই করা হয়। তবে বিশেষ ভাবে দুর্গাপুজো ও জগদ্ধাত্রী পুজো হয়। রাজবাড়ির মা দুর্গা ‘রাজেশ্বরী’ নামে পরিচিত। এখানে মায়ের রূপও অনেক আলাদা। সিংহের পরির্বতে মা এখানে ঘোড়ার উপর বিরাজমান। প্রাচীন রীতি অনুযায়ী আজও দেবীর পিছনে চালিতে চালচিত্র দেখা যায়। আগে এখানে পশুবলি হত। বর্তমানে এই প্রথা বন্ধ। সব বারোয়ারি পুজোর ঠাকুর রাজবাড়ি হয়ে তবেই বির্সজনে যায়।
সকলেই সুখী হোন, সকলেই অসুস্থতামুক্ত থাকুন, সকলেই মঙ্গল দেখতে পান, কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি তাদের রাজ রাজেশ্বরী দুর্গাপূজার সময় সকলের জন্য এটাই প্রার্থনা করে। গত ৩০০ বছর ধরে পালিত হয়ে আসছে এই মহিমান্বিত পূজা, যা ১৬৮৩ সালে শুরু হয়েছিল। এই পূজা শুরু করেছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের প্রপিতামহ মহারাজা রুদ্র রায়, যিনি নদীয়ার মানুষের শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য প্রথম দেবী দুর্গার পূজা করেছিলেন। রাজবাড়ির কেন্দ্রীয় প্রাঙ্গণে সুন্দর দুর্গা মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল এবং ঐতিহাসিক প্রাসাদটি একটি দীঘি বা জলাশয় দ্বারা বেষ্টিত। এই দীঘিতে মূর্তি সহ মন্দিরের প্রতিচ্ছবি মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো।
দুর্গাপূজা ছাড়াও, রাজবাড়ি ঝুলন মেলা এবং বড় দোলের মতো আরও বেশ কিছু উৎসব উদযাপিত হয় এখানে। এই পুজোর বিশেষত্ব হল রাজ বাড়ির সব সদস্যরা যারা যেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন হুজুর এ কটা দিন সবাই রাজবাড়ীতে একত্রিত হন। শুধু তাই নয় সমগ্র নদীয়া জেলা উপচে পড়ে রাজবাড়ির পুজো দেখতে। রাজ রাজেশ্বরী রীতিতে তৈরি এই প্রতিমার অলংকরণ, কলকাতার বেশিরভাগ বনেদি বাড়ির পুজোয় প্রচলিত 'ডাকের সাজ' থেকে আলাদা। বরং এই বিশেষ সাজটি 'বেদেনী ডাক' নামে পরিচিত।
রাজ রাজেশ্বরী মাকে পাটে তোলার পর
একটা সময় ছিল যখন সন্ধিপুজো খুব ধুমধামের সাথে অনুষ্ঠিত হত এবং রাজবাড়ির কামান বাজানো হত যাতে শব্দ দূর-দূরান্তে পৌঁছে যায়। আজকাল তোপ আর সন্ধিপুজোর অংশ নয়, যা ১০৮টি পদ্ম ফুল এবং ১০৮টি প্রদীপ নিবেদনের মাধ্যমে পালন করা হয়। আগে দুর্গাপুজোয় ছাগল বলি দেওয়া হত। এখন অবশ্য কেবল আখ এবং চালকুমড়ো বলি দেওয়া হয়।
রাজ রাজেশ্বরী রূপকে সম্পদ ও সুখের দেবী লক্ষ্মীর অবতার বলা হয়। যোদ্ধা দেবী দারিদ্র্য, ক্ষুধা, নিষ্ঠুরতা, দুর্নীতি, নিপীড়ন, অশিক্ষা, দমন, অনৈতিকতা, লিঙ্গ বৈষম্য, দুঃখ এবং বেদনার মতো সকল মন্দের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিশ্ব এবং নদীয়ার মানুষকে রক্ষা করার জন্য মানুষের মধ্যে সুখ বয়ে আনেন বলে মনে করা হয়। প্রথম মূর্তিটি বিশেষভাবে সাধন পাল দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল যিনি ১৯৬৭ সালে মারা যান এবং তার পরে মূর্তির চেহারায় সামান্য পরিবর্তন এসেছে। সামনের দেবীর দুটি হাত পিছনের আট হাতের চেয়ে ছোট। চালচিত্রে দশাবতার চিত্রিত করা হয়েছে এবং দশমহাবিদ্যাও রয়েছে। রাজবাড়ির রানী মহালয়ার পরে একটি বিশেষ হোমাগ্নি বা অগ্নি প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে পুজো শুরু করেন। নবমী পর্যন্ত এই আচার-অনুষ্ঠানের আগুন জ্বলতে থাকে।
চার দিনের উৎসবের অংশ হিসেবে, প্রতিমা বিসর্জনের পর পরিবারটি 'শত্রু বধ' নামে একটি অনুষ্ঠান উদযাপন করে। জনশ্রুতি আছে যে, এই অনুষ্ঠানটি রাজা কৃষ্ণ চন্দ্র দ্বারা শুরু হয়েছিল, যিনি দুর্গার কাছে শক্তির জন্য প্রার্থনা করেছিলেন যাতে তিনি জনগণের অভিযোগ দূর করতে পারেন এবং অশুভ শক্তিকে বধ করতে পারেন। শত্রু বধের সময়, রাজপরিবারের একজন সদস্য, যিনি রাজার প্রতীক, একটি ধনুক এবং তীর তুলে শত্রুর একটি মাটির প্রতিকৃতিতে নিক্ষেপ করেন। সিঁদুর খেলা এখনও একটি রাজকীয় অনুষ্ঠান যেখানে প্রায় ১০,০০০ মহিলা এতে অংশগ্রহণ করেন।
কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির অন্দরমহলের দৃশ্য
আরেকটি উল্লেখযোগ্য রীতি হল যাত্রামঙ্গল, যখন রাজা জনগণের সাথে দেখা করতে এবং তাদের সাথে আলাপচারিতা করতে বেরিয়ে আসেন। পূজার চারদিনই দর্শনার্থীদের মধ্যে প্রসাদ বিতরণ করা হয়। নৈবেদ্যগুলি পূজার মতোই রাজকীয়।
নৈবেদ্যগুলি মহালয়া থেকে শুরু হয় এবং সপ্তমীতে সাত ধরণের ভাজা খাবার দেওয়া হয়, অন্যদিকে অষ্টমীতে আট ধরণের পোলাও এবং ছানার ডালনা, মিষ্টি এবং ক্ষীর দেওয়া হয়। নবমীতে, প্রসাদটি আমিষ হয় এবং এতে নয়টি ভাজা খাবার, তিন ধরণের মাছ, ভাত এবং মিষ্টি থাকে। দশমীতে ফল, দই এবং খই সহ সেদ্ধ ভাত এবং সিং মাছের একটি বিশেষ ভোগ দেওয়া হয়। এভাবেই রাজবাড়ীতে পুজোর সমাপন হয়।