শান্তি প্রিয় রায়চৌধুরী/হাওড়া
হাওড়ার বোনেদি বাড়ির দুর্গাপূজোর এমন অনেক পুজো আছে যে পুজো গুলো শতবর্ষ পেরিয়ে অনেক অনেক দূর চলে গেছে। পূজো গুলো কেবল পুরানোই নয়, বিখ্যাতও। হাওড়ার 'বোনেদি' পরিবারের সেই সব কিছু দুর্গাপূজা নিয়েই এই প্রতিবেদন।
বালির বুড়িমার আটচালা : সম্রাট শাহজাহানের আমলের পুজো
বালির চৈতলপাড়া বুড়ি মার আটচালার পূজা। এই পূজা প্রায় ৪০০ বছর এবং মুঘল সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে শুরু হয়েছিল। এই পূজাটি এক সময় পারিবারিক পূজো ছিল, যেটি এখন পূজা কমিটির দখলে চলে গেছে। এই পূজোর বয়সের কারণেই এর নামকরণ করা হয়েছে বুড়িমার পূজা।
বালির বুড়িমা
এই পূজা মহালয়ার পরের দিন থেকে শুরু হয়ে দশমীর দিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। 'নবপত্রিকা', যা সাধারণত গঙ্গায় স্নান করিয়ে পূজা করা হয়, ষমন্দির প্রাঙ্গণে পূজা করা হয়। সপ্তমীতে কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এখানে কাম্য পূজা যা মহাষ্টমীতে অনুষ্ঠিত হয়। ভক্তরা দেবীকে শাড়ি, আলতা , সিঁদুর এবং মিষ্টি নিবেদন করে। আগে এখানে পশু বলি দেওয়ার প্রথা ছিল কিন্তু এখন আর হয়না, পরিবর্তে শাকসবজি উৎসর্গ করা হয়।
হাওড়ার আন্দুলের দত্ত চৌধুরী পরিবারের ৪৫০ বছরের দুর্গাপূজা:
হাওড়ার আন্দুলের চৌধুরী পাড়া লেনের দত্ত চৌধুরী পরিবারের দুর্গাপূজা ৪৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। ১৫৬৮ সালে রামশরণ দত্ত চৌধুরী এই পূজা শুরু করেছিলেন। নবমীর দিনে কুমারী পূজা এবং ধুনো পোড়ানো উভয়ই অনুষ্ঠিত হয়। এখানে বৃহৎনান্দীকেশ্বর পুরাণ অনুসারে পূজা হয় এবং পরিবার বৈষ্ণব রীতি অনুসরণ করে। নবমীতে এখানে শাকসবজির বলি করা হয়, দত্ত চৌধুরীর পরিবারের মতে, পশু বলি দেওয়া।
হাওড়ার আন্দুলের দত্ত চৌধুরী পরিবারের ৪৫০ বছরের দুর্গাপূজা
এখানকার ঠাকুর তৌরির বিশেষত হল প্রাথমিক পর্যায়ে মূর্তি তৌরি করার জন্য আলাদা ব্যক্তি এখানে আসেন,প্রতিমা রঙ করার জন্য আসে একজন আলাদা ব্যক্তি, চোখ আঁকার জন্য আসে একজন আলাদা ব্যক্তি। আবার প্রতিমার চোখ আঁকার জন্য কৃষ্ণনগরের একজন শিল্পী এখানে আসেন।
আন্দুল রাজ পরিবারের দুর্গাপূজা, হয়ে আসছে ১৭৭০ সাল থেকে:
১৭৭০ সালে রামলোচন রায় আন্দুল রাজ পরিবারের দুর্গাপূজা শুরু করেন। আন্দুল রাজবাড়ির ভেতরে একটি সুন্দর উঠোন, যা চণ্ডী মণ্ডপ নাম। রাজবাড়ির পাশে একটি পৃথক ঠাকুরদালানে পূজা অনুষ্ঠিত হয় । রায় পরিবারের শেষ বংশধর মারা যাওয়ার পর থেকে মিত্র পরিবার এখন এই পূজা উদযাপন করে। ঐতিহ্যগতভাবে প্রতিমা একচালা এবং সিংহের রঙ সাদা।
আন্দুল রাজ পরিবারের দুর্গাপূজা
শিবপুর ভট্টাচার্য পরিবারের ৩৫০ বছরের দুর্গাপূজা:
হাওড়ার ১৭১, শিবপুর রোডের ভট্টাচার্য পরিবারের দুর্গাপূজা শুরু করেছিলেন রঘুনাথ শিরোমণি (ভট্টাচার্য) এর জ্যেষ্ঠ পুত্র কৃষ্ণচরণ ভট্টাচার্য, প্রায় ৩৫০ বছর আগে।
এই পূজার বিশেষত্ব হলো কালাবৌ (নবপত্রিকা) যা গণেশের পরিবর্তে কার্তিকের মূর্তির পাশে স্থাপন করা হয় কারণ কার্তিক গণেশের চেয়ে পুরনো। শাক্ত রীতি অনুসারে এখানে পূজা পালিত হয়। নবমীতে কুমারী পূজা পালিত হয় এবং অষ্টমী ও নবমী উভয় দিনেই ধুনো পোড়ান পালিত হয়। এখানকার সিংহটি সাদা রঙের এবং নৃসিংহ নামে পরিচিত। ভট্টাচার্য পরিবারের মতে, এখানে একটি পঞ্চমুন্ডির আশন (পাঁচটি খুলির ধ্যান আসন) রয়েছে যার উপরে প্রতিমা স্থাপন করা হয়েছে। জগদ্ধাত্রী এবং অন্নপূর্ণা পূজা এখানে একই দালানে পালিত হয়।
শিবপুর ভট্টাচার্য পরিবারের ৩৫০ বছরের দুর্গাপূজা
শিবপুর রায়চৌধুরী বাড়ির দূর্গা পূজা, শুরু হয়েছিল ১৬৮৫ খিস্ট্রাব্দে:
হাওড়ার শিবপুর রোডের ৪৬এ/১১-এর রায়চৌধুরী পরিবারের দুর্গাপূজা শুরু হয়েছিল বাংলা ১০৯২ সালে, যা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে ১৬৮৫ খ্রিস্টাব্দে। রায়চৌধুরী জমিদার পরিবারের রাজা রামব্রহ্ম রায়চৌধুরী "সাঁঝের আটচালা" নামে পরিচিত আটচালায় মূর্তিটি স্থাপন করেছিলেন। পূজার তিন দিনই পশু (ছাগল) বলি দেওয়া হয়। মা দুর্গার প্রতিমাটি দর্শনীয়।
রায়চৌধুরী বাড়ি দূর্গা পুজো (সাঁঝের আটচালা)
কে পলের পারিবারিক দুর্গাপূজা, ৩০০ বছরের পুরোনো
শিবপুরের নব গোপাল মুখার্জি লেনের বি কে পালের পরিবারের দুর্গাপূজা প্রায় তিনশ বছরের পুরনো। এটি বিখ্যাত ফার্মাসিস্ট বট কৃষ্ণ পালের পৈতৃক বাড়ি। এখানে মা দুর্গার মূর্তি হল অভয়া মূর্তি, যেখানে মা দুর্গার আছে দুটি হাত- এক হাতে তিনি আমাদের আশীর্বাদ করছেন এবং অন্য হাতে তিনি ফল সহ একটি পূর্ণ প্রস্ফুটিত পদ্ম ধরে আছেন। মা দুর্গার মূর্তিটি এখানে কোনও অসুর ছাড়াই। রথযাত্রার শুভ দিনে কাঠামো পূজা করা হয় এবং এখানকার মূর্তিটি ঠাকুরদালানেই তৈরি করা হয়।
কে পলের পারিবারিক দুর্গাপূজা, ৩০০ বছরের পুরোনো
দেবীপক্ষের এক পক্ষকাল আগে কৃষ্ণ নবমী তিথিতে অভয়া দুর্গার বোধন শুরু হয়। নবমী পর্যন্ত চণ্ডীপাঠ পালিত হয়। এখানে শাক্ত রীতি অনুসারে পূজা হয় আর তান্ত্রিক রীতি অনুসারে সন্ধি পূজা করা হয়। অষ্টমীতে ধুনো পোড়ান হয়, যেখানে কেবল পাল পরিবারের সব মহিলারা ছাড়া পাড়ার অন্যান্য মহিলারাও অংশ নিয়ে থাকেন। সপ্তমী, অষ্টমী এবং নবমীর দিন পশু বলি দেওয়া হয়, যার মধ্যে মহিষ বলি আছে। তবে মহিষ বলি হয়ে থাকে শুধুমাত্র নবমীতে।