কলকাতার বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজো, যেখানে ইতিহাস কথা বলে

Story by  atv | Posted by  Aparna Das • 5 d ago
কলকাতার বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজো  (ফাইল)
কলকাতার বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজো (ফাইল)
 
শান্তিপ্রিয় রায় চৌধুরী , কলকাতা

কলকাতার বনেদি বাড়ির কিছু দুর্গাপুজো আজও অতীত ঐতিহ্য স্মরণীয়। যেখানে ইতিহাস কথা বলে। বিস্তৃত প্রায় সেই অতীত ইতিহাসকে তুলে ধরলেন  শান্তিপ্রিয় রায়চৌধুরী। 
 
ঘোষাল বাড়ির ২৭৬ বছরের পুজো
 
শিয়ালদহের সূর্যসেন স্টেট এর ঘোষাল বাড়ির পুজোর বয়স ২৭৬ বছর হয়ে গেল। এই পুজোর শুরু করেন জমিদার রূপনারায়ণ ঘোষাল। প্রতিমা এক চেলার প্রতিমা গড়েন মন্মথ পালের বংশধররা। পুজো হয় সনাতন রীতি মেনে। পুজোতে বলি হত। বলি বন্ধ ১৮৮৯ সাল থেকে। কারণ বলি প্রদত্ত ছাগ শিশু হাত ফস্কে পালিয়ে যায়। তবে পুজোর আড়ম্বর আজ আর তেমন কিছু নেই। 
 
ঘোষাল বাড়ির ২৭৬ বছরের পুজো (ফাইল)
 
পাথুরিয়া ঘাটা ঘোষ বাড়ির ৩২৬ বছরের পুজো, লর্ড হেস্টিংস এখানে এসেছিলেন
 
উত্তর কলকাতার পাথুরিয়া ঘাটা ঘোষ বাড়ির পূজো ৩২৬ বছর ছুয়ে ফেলেছে। পুজো দেখতে দূর দূরান্ত থেকে বহু মানুষ ও পর্যটক আসেন এখানে। এই বাড়ির কর্তা রামলোচন ঘোষ ছিলেন লর্ড হেস্টিংসের দেওয়ান। শোনা যায় এক সময় নাকি এই বাড়ির দুর্গা পুজো দেখতে হেস্টিং সাহেব এসেছিলেন। এখানকার প্রতিমা প্রথা অনুযায়ী উল্টো রথের দিন শুরু হয়। প্রতিমা হয় ডাকের সাজে সজ্জিত। এই বাড়ির প্রতিমা হয় তিন কোনা বিশিষ্ট চালচিত্রে। এখানকার পুজোর কয়েকটি বিশেষ প্রথা আছে যেমন, কলা বউকে স্নান করানোর জন্য বাইরে আনা হয় না। বাড়ির ঠাকুরদালানেই কলা বউকে স্নান করানো হয়। পুজোয় বলি দেওয়া হয় চাল কুমড়ো আর চিনির মঠ। এক সময়ে এই বাড়ির পুজোতে সোনা রুপোর বাসনপত্রের চলছিল। তবে এখনো পুরনো ঐতিহ্য ধরে রাখতে বর্তমানের বাড়ির কর্তারা কসুর করেন না।
 
পাথুরিয়া ঘাটা ঘোষ বাড়ির ৩২৬ বছরের পুজো
 
বাগবাজার হালদার বাড়ির ৪১৫ বছরের পুজো
 
উত্তর কলকাতার বাগবাজারের হালদার বাড়ির ৪৫ বছরের পুজো। আজও মহা সমারোহে হয়। স্বভাবতই রাজবল্লভ পাড়ার হালদার বাড়ির বিখ্যাত পুজোর গোড়ার ইতিহাস হারিয়ে গেছে কালস্রোতে। তবে শোনা যায়, স্বপ্নাদেশে এই পুজো শুরু করেন প্রাণ কৃষ্ণ হালদার। কৃষ্টি পাথরের দশভুজার কোনও  ছেলেমেয়ে নেই, আছেন শুধু দুই সখী জয়া ও বিজয়া। প্রতিমাটি স্থায়ী, তাই পুজো হয় সারা বছর ধরে। 
 
বাগবাজার হালদার বাড়ির ৪১৫ বছরের পুজো 
 
দাবাড়ির ১৮৫ বছরের পুজো 
 
উত্তর কলকাতা জোড়াসাঁকো অঞ্চলে বিখ্যাত দা বাড়ি। এই বাড়ির দুর্গাপুজো ১৮৫ বছর ধরে চলে আসছে। রথের দিন ধর্মীয় আচরণ বিধি মেনে তৈরি হয় প্রতিমা তৈরীর কাজ। প্রতিমাটি একচালার, ডাকে সাজের হয়। প্রতিমার উচ্চতা ১৬ ফুট। পুজোর ভোগ তৈরি হয় গঙ্গা জলে। অন্য ভোগের রীতি নেই। এই বাড়ির পুজোর আরেক বৈশিষ্ট্য হলো পুজোর ধুপ ও প্রদীপ সলতে সবই বাড়িতে তৈরি করা হয়। 
 
দাবাড়ির ১৮৫ বছরের পুজো
 
হাটখোলার দত্ত বাড়ির ২৩১ বছরের পুজো, এখানে এক সময় নরবলি হতো
 
উত্তর কলকাতা নিমতলা ঘাট স্ট্রিটে ঐতিহ্যশালী দত্ত পরিবারের বাড়িতে দুর্গা পুজো শুরু হয় ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত এই বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়ে আসছে। যে ঠাকুর দালানে প্রতিমা রাখা হয় সেটি মাটির তৈরি দালানে। প্রবাদ আছে এই ঠাকুর দালান নতুন করে তৈরির সময় পরিবারের নাকি কয়েকজনের অকাল মৃত্যু হয়েছে। তাই ঠাকুর থাকেন মাটির দালানে। দত্ত বাড়ির দুর্গা প্রতিমা হয় এক চালচিত্রের ও ডাকে সাজের। দেবীর পরনে মাটির শাড়ি। প্রতিবছর উল্টো রথের দিন কাঠামো পুজো করে শুরু হয় দেবী মূর্তি গড়ার কাজ। এখানকার প্রতিমার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো দেবীর সঙ্গে সিংহের বদলে থাকে নরসিংহ মূর্তি।
 
হাটখোলার দত্ত বাড়ির ২৩১ বছরের পুজো
 
বর্তমানে পরিবারের অনেক শরিক হওয়ার প্রতিবছর তারা পালা করে পুজোর দায়িত্ব নেন। প্রতিমা সিংহাসনে বসার পর ব্রাহ্মণ ছাড়া কারো প্রতিমা স্পর্শ করার নিয়ম নেই। পরিবারের নিয়মানুসারে বাড়ির মেয়েরা চিকের আড়ালে বসে পুজো দেখেন। এক সময় নরবলি হতো এই পুজোতে। বর্তমানে  অষ্টমীর দিনে ক্ষীরের পুতুল বলি দেয়া হয়। বলি একমাত্র মেয়েরা দেখতে পারে।
 
ভোরের ভোগে রয়েছে নানান বৈচিত্র্য। প্রতিমা নিরঞ্জনের ঐতিহ্য মেনে নীলকন্ঠ পাখি উড়িয়ে দেয়া হত। কিন্তু এখন আর নীলকন্ঠ পাখি ওড়ানো হয় না। কোন এক অজ্ঞাত কারণে প্রতিমা নিরঞ্জনের পর পুরুষেরা বাড়ি ফেরেন গরুর লেজ ধরে। এটাই হচ্ছে এই বাড়ির প্রথা। এছাড়াও আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো এই বাড়ির মেয়েরা দশমীর পরিবর্তে সন্ধিপুজো হলেই সিঁদুর খেলেন। দত্ত বাড়িতে দুর্গা পুজোর মত কালীপুজোও খুবই বিখ্যাত।