দেবকিশোর চক্রবর্তী,কলকাতা
জীবনে একবার লিওনেল মেসিকে নিজের চোখে দেখার স্বপ্ন নিয়ে শনিবার কলকাতার বিবেকানন্দ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গণে হাজির হয়েছিলেন হাজার হাজার ফুটবলপ্রেমী। কারও গলায় আর্জেন্টিনার জার্সি, কারও হাতে নীল-সাদা পতাকা। কিন্তু সেই স্বপ্নের পরিণতি হলো হতাশা, ক্ষোভ এবং প্রশ্নচিহ্নে ভরা এক রাত। মেসির সংক্ষিপ্ত উপস্থিতি, দুর্বল ব্যবস্থাপনা এবং প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অভিযোগে উত্তাল হয়ে ওঠে যুবভারতী।
ভক্তদের অভিযোগ, আয়োজকদের তরফে প্রচার করা হয়েছিল যে মেসি মাঠে দীর্ঘ সময় থাকবেন, দর্শকদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখবেন এবং ভক্তদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করবেন। সেই আশাতেই বহু মানুষ উচ্চমূল্যের টিকিট কিনে ছিলেন। কেউ কেউ জেলা ও ভিনরাজ্য থেকে এসে রাতভর স্টেডিয়ামের বাইরে অপেক্ষা করেন। কিন্তু অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে যায়, প্রত্যাশা আর বাস্তবতার মধ্যে বিস্তর ফারাক।
মেসি মঞ্চে উঠলেও তাঁকে দেখা যায় মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য। দূরের গ্যালারিতে বসা দর্শকদের বড় অংশের কাছেই তিনি ছিলেন প্রায় অদৃশ্য। “এত টাকা খরচ করে এসেছিলাম, অন্তত একবার হাত নাড়তে দেখব ভেবেছিলাম,” বললেন এক কলেজ পড়ুয়া ভক্ত বাঁকুড়ার কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। অনেকের চোখে তখন জল, অনেকের মুখে ক্ষোভ।
মেসির দ্রুত প্রস্থান করার খবর ছড়িয়ে পড়তেই গ্যালারিতে শুরু হয় প্রতিবাদ। স্লোগান, প্রশ্ন আর হতাশার আওয়াজে উত্তাল হয়ে ওঠে স্টেডিয়াম। কিছু জায়গায় উত্তেজিত জনতা গ্যালারির চেয়ার ভাঙচুর করে। ব্যারিকেড টপকে মাঠে নামার চেষ্টা হয়। যদিও অধিকাংশ ভক্ত এই আচরণে সায় দেননি, তবু আবেগ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশকে হস্তক্ষেপ করতে হয়।
ভক্তদের ক্ষোভ আরও তীব্র হয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া কিছু ছবি দেখে। সেখানে দেখা যায়, মেসিকে ঘিরে রয়েছেন রাজনৈতিক নেতা ও বিশেষ অতিথিরা, যারা তাঁর সঙ্গে সেলফি তুলছেন। গ্যালারিতে বসে থাকা সাধারণ ভক্তদের কাছে এই দৃশ্য ছিল অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক। এক প্রবীণ ফুটবলপ্রেমীর কথায়, “আমরা সারাজীবন মেসির খেলা দেখে বড় হয়েছি, আর আজ তাঁকে কাছে পেয়ে ছবি তুলছে তারা, যারা টিকিটই কাটেনি।”
সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে। ভক্তদের একাংশ দাবি করেছেন, টিকিট বিক্রির সময় ‘মেসির সঙ্গে দেখা’, ‘ক্লোজ ভিউ’ কিংবা বিশেষ অভিজ্ঞতার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। বাস্তবে সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি। ফলে বহু ভক্ত এটিকে সরাসরি প্রতারণা বলে দাবি করছেন এবং টিকিটের টাকা ফেরতের দাবি তুলেছেন।
এই ঘটনার পর প্রশাসনিক স্তরেও নড়াচড়া শুরু হয়। অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করে পুলিশ। ঘটনার পরদিন কলকাতা বিমানবন্দর থেকে মেসির সফরের অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা শতদ্রু দত্তকে আটক করা হয় বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে এবং আয়োজন সংক্রান্ত আর্থিক লেনদেন ও প্রতিশ্রুতির বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
ঘটনার এই পরিণতি কিছুটা হলেও ভক্তদের মনে আশার আলো জাগিয়েছে। অনেকেরই বক্তব্য, মেসি তাঁদের নায়কই থাকবেন, কিন্তু তাঁর নাম ব্যবহার করে যে ভাবে আবেগ ও অর্থের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে, তার জবাবদিহি হওয়া জরুরি।
কলকাতার ফুটবলপ্রেমী সংস্কৃতিতে মেসির আগমন একটি ঐতিহাসিক উৎসব হয়ে উঠতে পারত। কিন্তু দুর্বল পরিকল্পনা ও স্বচ্ছতার অভাবে সেই উৎসব পরিণত হলো হতাশার স্মৃতিতে। শনিবার যুবভারতীতে উপস্থিত হাজার হাজার ভক্তের কাছে এই সফর মনে থাকবে, মেসির জাদুতে নয়, অপূর্ণ স্বপ্ন আর প্রশ্নের ভারে।