আব্দুর রশিদ চৌধুরী
অসমীয়া জীবনী সাহিত্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এই জীবনী সাহিত্যের একটি বড় অংশ হল ইসলামিক জীবনী। অসমীয়া জীবনী সাহিত্যের বিকাশে সহায়ক হয়েছে। ইসলামিক জীবনী, বিশেষ করে নবী মুহাম্মদ ও তাঁর চার খলিফার জীবনী, অসমীয়া ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। আসামের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ও ভারতরত্ন গোপীনাথ বরদলৈ অসমীয়ায় নবী মুহাম্মদের প্রথম জীবনী রচনা করেছিলেন।
১৯৪২ সালের ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন’-এর সময় গোপীনাথ বরদলৈ যখন কারাবন্দি ছিলেন, তখন তিনি শিশুদের জন্য কয়েকটি জীবনী রচনা করেন। তাদের মধ্যেই একটি জীবনী ছিল ‘
হজরত মুহাম্মদ’ শীর্ষক। ঐতিহাসিকভাবে, নবী মুহাম্মদের অসমীয়া ভাষায় লেখা প্রথম জীবনীটি গোপীনাথ বরদলৈ-এরই রচনা। তিনি এই বইটি শিশুদের উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন। বরদলৈ তাঁর প্রতিটি জীবনীতে পাঠকদের (শিশুদের) উদ্দেশ্যে ‘পুত্র’ বা ‘স্নেহের পুত্র’ বলে সম্বোধন করতেন। নবী মুহাম্মদের জীবনী লেখার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। তিনি শুরু করেন, “পুত্র, এখন আমি তোমাকে ইসলামের প্রচারক নবী মুহাম্মদের জীবনী সংক্ষেপে বলবো।”
নবী মুহাম্মদের জীবনী লেখার আগে আসামের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ শ্রী রামচন্দ্র, গৌতম বুদ্ধ ও যিশু খ্রিস্টের জীবনী রচনা করেছিলেন। নবী মুহাম্মদের জীবনীটির শুরুতে বরদলৈ বলেন, অন্যান্য সাধু-সন্তের জীবনীতে অনেক অলৌকিক ও আশ্চর্যজনক ঘটনার বর্ণনা রয়েছে। কিছু লোক নবী মুহাম্মদের জীবনীতেও এমন অলৌকিক বিষয় যোগ করেছেন। তবে বরদলৈ স্বীকার করেন, নবী মুহাম্মদের জীবনী অন্যান্য মহান ধর্মপুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি ঐতিহাসিক।
নবী মুহাম্মদের মানবতা
এই জীবনীটিতে নবী মুহাম্মদের জন্ম থেকে শুরু করে তাঁর ধর্মপ্রচারের কাজ,দেশ পরিচালনা এবং মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের সকল দিক সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বরদলৈ চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন, কীভাবে নবী মুহাম্মদ -কে তাঁর ধর্মপ্রচারের শুরু থেকেই অবমাননা ও অপমান সহ্য করতে হয়েছে এবং কীভাবে তিনি মদিনায় হিজরত করেন। তিনি এই সময়কালে নবী মুহাম্মদের অসীম ধৈর্যেরও প্রশংসা করেছেন। পাশাপাশি তিনি উল্লেখ করেছেন, মানবজাতি কীভাবে নবী মুহাম্মদের জীবন থেকে ধৈর্যের শিক্ষা নিতে পারে।
অন্যদিকে, বরদলৈ তাঁর বইয়ে লেখেন যে, নবী মুহাম্মদ কখনও তাঁর শত্রুদের প্রতি কটূক্তি বা কঠোর ভাষা ব্যবহার করেননি। বরদলৈ লেখেন, “আরও প্রশংসনীয় হল তাঁর (নবীর) নিজের বিরোধী ও শত্রুদের প্রতি আচরণ। তোমরা পড়েছ কীভাবে পাপাচারী কুরাইশরা তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করেছিল। কিন্তু তিনি কখনও এই শত্রুদের সাথে কঠোর ভাষায় কথা বলেননি। নবী মুহাম্মদের শাসনে জোর-জবরদস্তির কোনও স্থান ছিল না। তিনি আলোচনার মাধ্যমে, চুক্তি ও বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে শাসন চালাতেন। এই রাজ্য পরিচালিত হত চুক্তি ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে। এখানে বলপ্রয়োগের কোনও স্থান ছিল না,” বরদলৈ লেখেন।
নবী মুহাম্মদের রাষ্ট্র সকলের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিল। তবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে তিনি অহিংস নীতিকে ত্যাগ করতে বাধ্য হন। গোপীনাথ বরদলৈ তাঁর লেখনীতে জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর নবী মুহাম্মদ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন।
প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ও ভারতরত্ন গোপীনাথ বরদলৈর অসমীয়ায় নবী মুহাম্মদের প্রথম জীবনী প্রকাশ
“আমি এখন আগের চেয়ে আরও বেশি নিশ্চিত যে, ইসলাম যে বিশ্বমঞ্চে বিজয় লাভ করেছিল, তা তলোয়ারের শক্তির দ্বারা নয়, বরং ইসলামের নবীর সহজ-সরল জীবন, তাঁর নিঃস্বার্থতা, প্রতিশ্রুতি রক্ষা, ভয়হীনতা, বন্ধু ও অনুসরকারীদের প্রতি ভালোবাসা এবং আল্লাহর ওপর অগাধ বিশ্বাসের কারণেই তা সম্ভব হয়েছিল। বিজয়ের পেছনে তলোয়ার নয়, এইসব গুণ ও চারিত্রিক মহত্ত্বই সকল বাধা দূর করেছিল এবং সব সংকট জয় করতে সাহায্য করেছিল। কেউ আমাকে বলেছিল, দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসকারী ইউরোপীয়রা ইসলামের বিস্তার দেখে ভীত। সেই একই ইসলাম এক সময় মরক্কোতে আলো ছড়িয়েছিল এবং বিশ্বের মানুষের কাছে ভ্রাতৃত্ববোধের সুখবর পৌঁছে দিয়েছিল,”—বরদলৈ তাঁর নবী মুহাম্মদের জীবনীতে মহাত্মা গান্ধীর উদ্ধৃতির উল্লেখ করেন।
জীবনীর শেষের দিকে বরদলৈ সেই নির্যাতনের কথা বলেন, যা তিনি নিজের চোখে দেখেছেন এবং ইসলাম ধর্মের নামে অন্যদের উপর সংঘটিত হতে দেখেছেন। তিনি দেখেছেন, মুসলমানরা কখনও কখনও অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি শত্রুতার বশবর্তী হয়ে হিংসার আশ্রয় নিয়েছে। এই সম্পূর্ণরূপে ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রসঙ্গে বরদলৈ লেখেন, “আসলে এই বিরোধ বা বৈপরীত্যের মূল কারণ হল স্বার্থপরতা। যারা প্রকৃত ধর্মপ্রাণ, তাদের মধ্যে কখনো বিরোধ-বিদ্বেষ হতে পারে না। প্রতিটি দেশেই কিছু ধর্মীয় নেতা ও মৌলবি রয়েছেন, যারা নিজেদের ধর্মকে মহান প্রমাণ করার জন্য অন্য ধর্ম ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের হেয় করে দেখতে ও ঘৃণা করতে শেখান।”
বরদলৈ-এর অন্যান্য জীবনী রচনার মতো ‘হজরত মুহাম্মদ’ বইটির ভাষাও সহজ-সরল। তিনি শিশুদের জন্য উপযোগী ভাষা ব্যবহার করেছেন। ‘হজরত মুহাম্মদ’ জীবনীটি প্রতিটি অসমীয়ার পড়া উচিত। এই বই শুধু নবী মুহাম্মদের জীবনকাহিনি জানার সুযোগ দেবে না, বরং পাঠকদের ভারতরত্ন গোপীনাথ বরদলৈ-এর সাহিত্য প্রতিভা ও তাঁর অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার সাথেও পরিচয় করিয়ে দেবে।
(লেখক: আনন্দরাম সিনিয়র বেসিক স্কুল, উত্তর গুয়াহাটির শিক্ষক)