ডঃ ভুবনেশ্বৰ ডেকাঃ "জিকির-জারি" নিয়ে পিএইচডি করা অসমের প্রথম ব্যক্তি

Story by  atv | Posted by  Sudip sharma chowdhury • 7 d ago
বিশিষ্ট পণ্ডিত ডঃ ভুবনেশ্বৰ ডেকা
বিশিষ্ট পণ্ডিত ডঃ ভুবনেশ্বৰ ডেকা
 
দৌলত রহমান / গুয়াহাটি

অসমের বিশিষ্ট পণ্ডিত ডঃ ভুবনেশ্বৰ ডেকা মূলত একজন বিজ্ঞান স্নাতক ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি কলা (মানবিক) শিক্ষার দিকে অগ্রসর হন। তিনি বি.এ. এবং তিনটি এম.এ. ডিগ্রি অর্জন করেন। বিজ্ঞান ও কলা বিষয়ে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করার পরও জ্ঞান আহরণের প্রতি তাঁর আগ্রহ কমে যায়নি।অন্য ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত থাকলেও ডঃ ডেকা ইসলাম ধর্ম ও জীবনদর্শনকে বুঝতে গভীরভাবে আগ্রহী ছিলেন, বিশেষ করে অসমের প্রেক্ষাপটে। এই কৌতূহলের ফলেই তিনি "জিকির ও জারি" নিয়ে গবেষণা করে অসমে এই বিষয়ে একমাত্র পিএইচডি ডিগ্রিধারী ব্যক্তি ।

জিকির হলো অসমীয়া স্থানীয় মুসলিম সমাজে প্রচলিত ভক্তিমূলক গান। ২০১১ সালে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে অসমীয়া জিকির ও জারি নিয়ে বিস্তৃত গবেষণার জন্য পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করেন।
 

জিকির ও জারির অনুষ্ঠান
 
"আওয়াজ দ্য ভয়েস"-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ডঃ ডেকা জানান, তিনি ছোটবেলা থেকেই জিকির শুনে আসছেন এবং এই ভক্তিমূলক সংগীতের প্রতি তাঁর আকর্ষণ দিনে দিনে বেড়ে গেছে এর ঐক্যবদ্ধকরণের শক্তির জন্য।

তিনি বলেন, বৈষ্ণব সাধু ও মহাপুরুষ শ্রীমন্ত শঙ্করদেব (১৪৪৯-১৫৬৮)-এর ভক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে গড়ে ওঠা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে এবং আহোম রাজাদের (১২০০-১৮০০) পৃষ্ঠপোষকতায় জিকির ১৭শ শতকে অসমে নিজের ভিত্তি গড়ে তোলে। যদিও জিকির ও জারির সুর একইরকম, জিকির মূলত কোরআন ও হাদীসভিত্তিক ইসলামি শিক্ষার উপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে, জারি গান কারবালার যুদ্ধের করুণ ঘটনার উপর ভিত্তি করে তৈরি।

জিকিরগুলো ১৭শ শতাব্দীর সুফি সাধক ও কবি হযরত শাহ মিরান রচনা ও জনপ্রিয় করেছিলেন, যিনি "আজান পীর" নামেও পরিচিত। আজান পীর ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাগদাদ থেকে অসমে এসেছিলেন।

ডঃ ডেকা বলেন, জিকির গানে প্রথমত কোরআন ও হাদীসের আধ্যাত্মিক দিকগুলো পাওয়া যায়। কোরআন ও হাদীসের বাণী অনুসারে এই গানগুলি রচিত। দ্বিতীয়ত, আজান পীরের জিকিরে রয়েছে সাম্প্রদায়িক ঐক্যের বার্তা। শঙ্করদেবের অনেক নীতি ও আদর্শ জিকিরে প্রতিফলিত হয়েছে। তৃতীয়ত, অসমের বহুবিধ সংস্কৃতির ছাপ জিকিরে পাওয়া যায়। যেমন – বরগীত, বিয়াগীত, আইনাম, ধাইনাম, টোকারী লোকগান ইত্যাদি বহু অসমীয়া লোকসংস্কৃতি ও সংগীতের প্রভাব জিকিরে বিদ্যমান।

চতুর্থত, জিকিরে উদারচিন্তার প্রতিফলন দেখা যায়। যদিও হিন্দু ও মুসলমান আলাদা ধর্মীয় সম্প্রদায়, আজান পীর ও শঙ্করদেব উভয়েই এক ঈশ্বরের কথাই বলেছিলেন। যেমন শঙ্করদেব তাঁর বরগীতে বলেছিলেন, "এক দেব, এক সেব, এক বিনে নাই কেব" — ঠিক তেমনি আজান পীর তাঁর জিকিরে বলেছেন, "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ"। আজান পীর শঙ্করদেবের আদর্শকেই অনুসরণ করে জিকির রচনা করেছিলেন।

“যেভাবে শঙ্করদেব এক ঈশ্বরের উপাসনার কথা বলেছিলেন, ঠিক সেইভাবেই আজান পীরও এক ঈশ্বরের কথাই বলেছিলেন। এই দুই দিকের মধ্যে আমরা মিল পাই। যেমনভাবে বরগীত পরিবেশনের আগে শুদ্ধ আচরণ ও নীতির সঙ্গে প্রদীপ জ্বালানো হয়, ঠিক সেভাবেই জিকির গান পরিবেশনের আগে প্রদীপ জ্বালিয়ে সরায় (পুজার সামগ্রী) অর্পণ করা হত। এখনও অনেক স্থানে জিকির পরিবেশনের আগে এরকম আচার দেখা যায়। শঙ্করদেব বরগীত পরিবেশনের সময় হাত তালি বাজানোর নিয়ম করেছিলেন। তেমনি আজান পীরও জিকিরে হাত তালি বাজানোর প্রচলন করেন। শঙ্করদেব যেমন আসনে বসে সমবেতভাবে বরগীত গাইতেন, তেমনি আজান পীরও ভক্তদের নিয়ে আসনে বসে জিকির পরিবেশন করতেন। বর্তমানে অনেকে জিকিরকে একটি বাণিজ্যিক রূপে ব্যবহার করছে, যদিও আমরা যদি এর আধ্যাত্মিক দিকটি দেখি, তবে দেখতে পাবো বরগীতের মতো জিকিরেরও একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে,” বলেন ডঃ ডেকা।
 

ডঃ ভুবনেশ্বৰ ডেকাকে সংবর্ধনা
 
জিকিরের ভবিষ্যৎ নিয়ে ডঃ ডেকা বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন নন। তিনি বলেন, “আজান পীরের মৃত্যুর পর জিকির গানগুলো মৌখিকভাবে প্রজন্মান্তরে প্রবাহিত হয়েছে। তখন ধারণা করা হয়েছিল যে এই গানগুলো লিখে রাখা বা অন্যকে দেওয়া সম্ভব নয়। সেই কারণে এর যথাযথ প্রচার ও প্রসার হয়নি। যেমনভাবে সাহিত্যসম্রাট লক্ষ্মীনাথ বেজবড়ুয়া শঙ্করদেবের নামঘরের নামধর্মকে নতুন মাত্রা দিয়েছিলেন, ঠিক তেমনভাবে আজ নতুন প্রজন্ম জিকির গানের প্রচার ও প্রসারে এগিয়ে আসছে। তবে যেভাবে হওয়া উচিত ছিল, সেইভাবে তা এখনো হয়নি। অন্যদিকে, যেমনভাবে শঙ্করদেবের নামে সরকারিভাবে পুরস্কার দেওয়া হয়, তেমনি আজান পীরের নামেও এক সময় পুরস্কার চালু ছিল, কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে তা বন্ধ আছে। এই দুই দিক সমানতালে এগিয়ে যায়নি। আমরা যেমন শঙ্করদেবের নামে পুরস্কার পেয়ে আনন্দিত, তেমনি আজান পীরের নামেও পুরস্কার পুনরায় চালু করা হোক— আমরা তা কামনা করি।”

ডঃ ডেকা বলেন, ইতিমধ্যেই শঙ্করদেব ও মাধবদেবের ওপর বহু গবেষণা হয়েছে। স্নাতকোত্তর পাঠ্যক্রমে তাঁদের বহু সাহিত্য সংযোজিত হয়েছে। এমনকি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পাঠ্যক্রমেও শঙ্করদেবের বিষয়ে অন্তর্ভুক্তি রয়েছে। কিন্তু আজান পীরের আদর্শ এখনো পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। হাইস্কুলে সীমিতভাবে একটি প্রবন্ধ পাওয়া যায়, তবে আজান পীর ও জিকিরের আদর্শকে টিকিয়ে রাখতে হলে তা বাধ্যতামূলকভাবে সব স্তরের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। যদি তা করা হয়, তাহলে অবশ্যই নতুন প্রজন্ম জিকির ও আজান পীর সম্পর্কে জানতে পারবে এবং আজান পীরের যে দর্শন, তা সমগ্র অসমবাসী জানতে পারবে।

ডঃ ডেকা বিশ্বাস করেন, শঙ্কর-আজানের আদর্শ এখনো অসমে জীবন্ত। স্বাধীনতার পর ভারতে বহু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে। যেমন, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর বিভিন্ন স্থানে মন্দির ধ্বংস করা হয়েছে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তানেও এর প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে। কিন্তু অসমে একটিও নামঘর বা মন্দির ধ্বংস হয়নি। এটি একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এর একমাত্র কারণ হলো শ্রীমন্ত শঙ্করদেব ও আজান পীরের উদার আদর্শ।

তিনি আরও বলেন, “দ্বিতীয়ত, আমরা অসমে দেখতে পাই— যদি কোনো হিন্দু ব্যক্তির মৃত্যু হয় এবং আশেপাশে হিন্দু না থাকে, তাহলে মুসলিমরা তাঁর দেহ শ্মশানে নিয়ে গিয়ে হিন্দু রীতিতেই দাহ করে। একইভাবে, যদি কোনো মুসলমান ব্যক্তির মৃত্যু হয় এবং আশেপাশে মুসলিম না থাকে, তাহলে হিন্দুরা তাঁর কবরের ব্যবস্থা করে ইসলামিক রীতি অনুযায়ী। আমরা দেখি, মহাপুরুষ শ্রীমন্ত শঙ্করদেবের আদর্শে গড়ে ওঠা শঙ্করদেব সংঘের বার্ষিক সম্মেলনে হিন্দুদের সঙ্গে মুসলিমরাও অংশগ্রহণ করেন। দেড়গাঁওয়ের ভাগবত শোভাযাত্রার রথ মুসলমানদের দ্বারা সাজানো হয়েছিল। এধরনের দৃষ্টান্ত অন্য রাজ্যে দেখা যায় না। এবারের নাহারকটিয়ায় অনুষ্ঠিতব্য শঙ্কর সংঘের সম্মেলনে ২০০ জন মুসলমান ‘নরা’ কেটেছে (প্রসাদ প্রস্তুতিতে অংশ নিয়েছে)। এই ধরনের ঘটনা অসমে সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র শঙ্করদেব ও আজান পীরের উদার আদর্শের জন্য,”— বলেন ডঃ ডেকা।