২০০ বছর পুরনো আতরের দোকান হাজি খুদা বখ্শ নবী বখ্শ আজও চলছে রমরমিয়ে

Story by  Debkishor Chakraborty | Posted by  Aparna Das • 17 d ago
২০০ বছর পুরনো হাজি খুদা বখ্শ নবী বখ্শ আতরের দোকান
২০০ বছর পুরনো হাজি খুদা বখ্শ নবী বখ্শ আতরের দোকান
 
দেবকিশোর চক্রবর্তী

জায়গাটা মধ্য কলকাতার ৮৭ নম্বর কলুটোলা স্ট্রিট। এখানেই অবস্থিত  এক খুশবু বিপণি বা আতরের দোকান, হাজি খুদা বখ্শ নবী বখ্শ। দীর্ঘ ২০০ বছর পেরিয়েও রীতিমতো ব্যবসা করে চলেছে রমরমিয়ে।
 
সালটা ১৮২৪। লখনউ তখন দাঙ্গা বিধ্বস্ত। চারদিকে অশান্তি, অস্থিরতা। এমন পরিস্থিতিতে কনৌজের কারখানা থেকে সামান্য কিছু সুগন্ধী নিয়ে কলকাতায় পাড়ি দেন এক পিতা-পুত্র জুটি। হাজি খুদা বখ্শ ও তাঁর ছেলে নবী বখ্শ। এসে ঘাঁটি স্থাপন করেন বর্তমান কলকাতার কলুটোলা। এক চিলতে ছোট্ট দোকান থেকে ব্যবসা শুরু করেন। নাখোদা মসজিদ সংলগ্ন এলাকাটিতে সকাল থেকেই উপচে পড়ে ভিড়। মানুষে মানুষে সমাগম। নানান জিনিসের বেচাকেনার ব্যস্ততায় চোখে পড়ে একটি আতরের দোকানের সাইনবোর্ড। সেখানে জ্বলজ্বল করছে লেখা হাজি খুদা বখ্শ ও নবী বখ্শ।  সুগন্ধে ফুরফুরে হয়ে যায় বদ্ধ মেজাজও। কিন্তু এটা একদিনের কথা নয়, দীর্ঘ ২০০ বছর পুরোনো গল্প।
 
হাজি খুদা বখ্শ নবী বখ্শ আতরের দোকানের ছবি
 
সময়টা উনিশ শতক। ব্রিটিশ কোম্পানির রাজত্ব তখন দেশজুড়ে। একে একে এলাকা দখলে মত্ত কোম্পানি। ইংরেজদের মূল ঘাঁটি তখন বাংলা। ১৭৫৭-র পলাশি এবং ১৭৬৪-র বক্সার যুদ্ধের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বঙ্গদেশের দেওয়ানি লাভ করে। এর ফলে কলকাতা ধীরে ধীরে ব্রিটিশ প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। ১৭৭২ সালে গর্ভনর ওয়ারেন হেস্টিংস কলকাতাকে প্রশাসনিক রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেন। সুতরাং আরও গুরুত্ব বাড়ে অঞ্চলটির। আর এই সময় বহু মানুষ জীবিকার তাগিদে নব নির্মিত রাজধানীটিকেই তাদের নতুন ঠিকানা করে নেয়।   চিৎপুরে তখন খুব একটা আতরের দোকান ছিল না। ফলত অল্পদিনেই ছড়িয়ে যায় হাজি খুদা বখ্শ ও নবী বখ্শের বিপণির সৌরভ।
 
সেকালে আতর মূলত কিনতেন কলকাতার বাবু সমাজ। টেরিকাটা চুল, নাগড়া জুতো আর গিলে করা আদ্দির পাঞ্জাবিতে সুগন্ধী মেখে, জুড়িগাড়ি চেপে তারা হেঁকে বেড়াতেন সারা শহর।  শৌখনিতার সঙ্গে কখনোই আপোষ করতেন না বাবুরা। এই বাবুদের জীবন শৈলী নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'ঠাকুরদা' নামে একটি ছোটগল্পে লিখেছিলেন যে, 'তখনকার কালের বাবুয়ানার আদর্শ বড়ো সহজ ছিল না।' অন্যদিকে আশ্বিন, ১৩২৯-এর সন্দেশ পত্রিকায় এই নিয়ে একটি চমৎকার কবিতা লেখেন সুকুমার রায়:
 
অতি খাসা মিহি সুতি/ ফিনফিনে জামা ধুতি,/ চরণে লপেটা জুতি জরিদার।/ এ হাতে সোনার ঘড়ি,/ ও হাতে বাঁকান ছড়ি,/ আতরের ছড়াছড়ি চারিধার।/ চকচকে চুল ছাঁটা/ তায় তোফা টেরিকাটা-/ সোনার চশমা আঁটা নাসিকায়। 
 
হাজি খুদা বখশ নবী বখশ আতরের দোকানের ভেতরের ছবি
 
সময় হিসেবে আতর মাখতেন বাবুরা। আজও কিছু কিছু অভিজ্ঞ মানুষ সে প্রথা মেনে চলেন। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত অনুযায়ী পালটে যেত আতরের ঘ্রাণ। গরমে মূলত ফ্লোরাল সেন্ট মাখা হয়। এই যেমন বেল, জুঁই, গোলাপ, রজনীগন্ধা প্রভৃতি। অন্যদিকে শীতের সময়ে প্রাধান্য পায় শামামা, মুস্ক ও উদ। অনেক সময় রাত দিনেরও বিভেদ থাকে আবার।
 
এ বিষয়ে হাজি খুদা বখ্শ নবী বখ্শ-এ যোগাযোগ করলে জানা যায় বর্তমানে দোকানটি চালাচ্ছেন তাঁদের সপ্তম বংশধর-নিয়াজউদ্দিন আল্লাবক্শ ও তাঁর ভাই সফিকউদ্দিন আল্লাবক্শ। পাশাপাশি পরের প্রজন্মও প্রস্তুত। দোকানটি এখন বেশ গোছানো। থরে থরে সাজানো রয়েছে হরেক রকমের আতর। ছোটো, বড়ো, মাঝারি; কড়া, হালকা; কম দামি, বেশি দামি যার যেমন চাই। এছাড়াও আছে সু্রমা, কেশ তেল, গোলাপ জল, ক্যাওড়া জল ও বিরিয়ানি তৈরির মিঠা আতর। দোকানের কর্মচারীদের থেকে সে যুগের বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেল।
 
আতর তৈরির একটি ছবি
 
আতর শব্দটি ফার্সি শব্দ ‘ইতির’ (it’s’r) থেকে এসেছে, যার অর্থ সুগন্ধি বা সুগন্ধ। পারফিউম প্রস্তুত করতে যেমন অ্যালকোহল লাগে, তেমনই আতর তৈরির মূল উপাদান তেল। ঐতিহ্যগতভাবে বাষ্প পতন প্রক্রিয়ার দ্বারা এটি বানানো হয়। অবশ্য আজকালকার দিনে অনেকে কেমিক্যাল ব্যবহার করেন। হাজি খুদা বখ্শ নবী বখ্শ-এর তরফে মুশাইদ-উদ্দিন আল্লাবক্শ জানান ,“আমাদের সবকিছুই ন্যাচারাল। লখনউ আর কলকাতায় আমাদের কারখানা আছে। সেখানেই সবটা তৈরি করা হয়।” প্রস্তুতি ও পদ্ধতির ওপর আতরের দাম নির্ভর করে। ৩০০ টাকা ভরি (১০ গ্রাম) থেকে শুরু। এরপর ৪০০, ৫০০, ১০০০, ১৫০০- দাম বাড়তে থাকে। দোকানে বিভিন্ন সাইজের প্যাকেটজাত আতর আছে। তাছাড়া কেউ খুচরো চাইলে সেই ব্যবস্থাও হয়।
 
সে যুগে বাবুদের পাশাপাশি বনেদি বাড়িগুলোতেও নিয়মিত আতর যেত। পুজোর মুখে ভিড় হতো ঢালাও। রীতিমতো হিমশিম খেতেন খোদা বক্শরা। শোনা যায়, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি থেকে বরাত আসত। এমনকী স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও নাকি ব্যবহার করতেন এখানকার আতর। হালকা গোলাপ আর জুঁইয়ের গন্ধ ছিল তাঁর খাস প্রিয়। এছাড়াও বিখ্যাতদের তালিকায় রয়েছেন - নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহিদ সুরাবর্দি, পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকাত আলি খান ও রাজ্যপাল নুরুল হাসান-সহ আরও অনেকেই। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে এমন উদযাপন আজকাল খুব একটা আর চোখে পড়ে না।
 
হাজি খুদা বখশ নবী বখশ আতরের দোকানের  ভেতরের ছবি
 
যুগ বদলাচ্ছে। বিশ্বায়নের আবহে পালটে চলেছে চারপাশ। বর্তমানে আতরের বাজার কেমন এ প্রশ্নের জবাবে মুশাইদজির বক্তব্য বেশ ইতিবাচক। তিনি আরও জানান, “উদ আমাদের বেস্টসেলার। হোয়াইট উদ নিতে বহু মানুষ এখানে আসেন। রুহ-খস, বৃষ্টি ভেজা সোঁদা ঘ্রাণ- সবটাই আমাদের এখানে পাবেন।”
 
হালফিলে সাবেক রুচির পাশাপাশি নতুন গন্ধের সঙ্গেও এক্সপেরিমেন্ট করছেন তাঁরা। বর্তমান প্রজন্মের কথা ভেবে, ঝুঁকেছেন অনলাইনেও। ইউটিউব, ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম এখন সর্বত্রই হাজি খোদা বকশ নবী বকশ প্রচার করতে ব্যস্ত। তাছাড়া হোয়াটস্যাপ কিংবা ওয়েবসাইট থেকেও সরাসরি অর্ডার করা যায়। দেশের বিভিন্ন জায়গা এবং বিদেশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরাসরি ফোনে অর্ডার করে সামান্য ক্যুরিয়ার চার্জের বিনিময়ে ঘরে‌ বসেই হাতের নাগালে চলে আসে এই সুগন্ধি।