দেবকিশোর চক্রবর্তী
দক্ষিণবঙ্গ থেকে উত্তরবঙ্গ—একই আতঙ্কে কাঁপছে দুই প্রান্তের মানুষ। ‘এস আই আর’ (স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট)-এর ভয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করলেন উত্তরবঙ্গের এক কৃষক। আগরপাড়ার প্রদীপ করের মৃত্যুর ঘটনার পর দিনহাটায় ঘটল আরও এক একই রকম ঘটনা। এসআইআর আতঙ্কে বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন খাইরুল শেখ নামে এক কৃষক। তাঁকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, দিনহাটার খাইরুল শেখ (বয়স আনুমানিক ৪৫) পেশায় কৃষক। পরিবার সূত্রে খবর, কয়েকদিন ধরেই তিনি এলাকায় চলা তথাকথিত এসআইআর তদন্ত নিয়ে চরম উদ্বেগে ছিলেন। মঙ্গলবার রাতে তিনি মানসিকভাবে ভীষণ অস্থির ছিলেন বলে জানা যায়। বুধবার সকালে চাষের কাজ সেরে ঘরে ফেরার পরই বিষপান করেন। পরিবারের সদস্যরা বিষয়টি টের পেয়ে দ্রুত তাঁকে উদ্ধার করে দিনহাটা মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতাল সূত্রে খবর, সময়মতো ভর্তি করানোয় খাইরুলের অবস্থা এখন স্থিতিশীল। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, প্রাথমিক চিকিৎসার পর বিষক্রিয়ার তীব্রতা অনেকটাই কমে এসেছে।
এই ঘটনার সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের আগরপাড়ার প্রদীপ করের আত্মহত্যার ঘটনার মিল পাওয়া যাচ্ছে। কয়েকদিন আগেই এসআইআর আতঙ্কে প্রাণ দিয়েছিলেন প্রদীপ কর বলে অভিযোগ ওঠে। তাঁর মৃত্যুর পর থেকেই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এই প্রেক্ষিতে দিনহাটার ঘটনাকে ঘিরে নতুন করে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে।
তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বুধবার বলেন, “প্রদীপবাবুর বাড়িতে থাকার সময় খবর পাই, দিনহাটায় আরও এক ব্যক্তি এসআইআর আতঙ্কে বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।” অভিষেকের অভিযোগ, সাধারণ মানুষের মনে ভয় ছড়ানোর জন্যই এই ধরনের আতঙ্ক তৈরি করা হচ্ছে। তাঁর বক্তব্য, সরকার ইতিমধ্যেই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে এবং মানুষকে বিভ্রান্ত না হওয়ার আবেদন জানানো হয়েছে।
বিজেপি অবশ্য তৃণমূলের দাবি মানতে নারাজ। দলের এক রাজ্য নেতা বলেন, “এসআইআর আতঙ্ক বলে কিছু নেই। প্রশাসনের দুর্বলতা ও রাজনৈতিক চাপের কারণেই মানুষ অসহায় বোধ করছেন। সরকার নিজের তৈরি বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছে।”
দিনহাটা থানার পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনার খবর পাওয়ার পর তদন্ত শুরু হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এটি আত্মহত্যার চেষ্টা বলেই মনে করা হচ্ছে। পুলিশের এক আধিকারিক বলেন, কেউ যদি ভুল তথ্য ছড়িয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে থাকে, তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অন্যদিকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এসআইআর আতঙ্কে কেউ যেন বিভ্রান্ত না হন। প্রশাসনের তরফে কারও ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ বা ভয় দেখানোর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। যদি কেউ এমন ঘটনার মুখে পড়েন, তাহলে সরাসরি প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
দিনহাটার এই ঘটনার পর এলাকায় চরম উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, গুজব এমনভাবে ছড়িয়েছে যে মানুষ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। অনেকেই আশঙ্কা করছেন তাঁদের নামও নাকি কোনো ‘তালিকায়’ রয়েছে। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, অজানা আশঙ্কা থেকে সৃষ্ট এই ভয় সমাজে গভীর মানসিক চাপ তৈরি করছে। তাঁদের বক্তব্য, এই পরিস্থিতিতে প্রশাসনের উচিত সরাসরি মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে সঠিক তথ্য জানানো ও গুজব রোধে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
আগরপাড়ার প্রদীপ করের মৃত্যু এবং দিনহাটার খাইরুল শেখের আত্মহত্যার চেষ্টার মধ্যে মিল একটাই—‘এসআইআর আতঙ্ক’। দুই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এখন প্রশ্ন উঠছে, এই আতঙ্কের আবহ আর কতদূর ছড়াবে, আর কত সাধারণ মানুষ এর বলি হবেন।