দেবকিশোর চক্রবর্তী:
দক্ষিণেশ্বরের গঙ্গাতীরবর্তী ভবতারিণী কালীমন্দিরে আজও কালীপুজো মানেই এক চিরন্তন ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা। শহরের নানা প্রান্তে আধুনিকতার ছোঁয়া যতই ছড়িয়ে পড়ুক না কেন, দক্ষিণেশ্বরের কালীপুজো এখনও পালন করা হয় সেই প্রায় দেড়শো বছরের পুরনো রীতি মেনে যে রীতি শুরু হয়েছিল রাণী রাসমণির হাত ধরে।
১৮৫৫ সালে রাণী রাসমণি ভবতারিণী দেবীর উদ্যোগে এই মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সময় থেকে শুরু হওয়া কালীপুজোর প্রতিটি আচার আজও অক্ষত আছে মন্দিরের পূজার্চনার পরম্পরায়। সন্ধ্যা ছ’টার পর গঙ্গার আরতি দিয়ে পুজোর সূচনা হয়। এরপর একে একে সম্পন্ন হয় দেবীর আবাহন, চন্দন, ধূপ, দীপ ও নৈবেদ্য নিবেদন। গভীর রাত পর্যন্ত চলে মূল পূজা। বিশেষ আকর্ষণ থাকে প্রাচীন “বলি” প্রথা— যা এখন প্রতীকী আকারে কুমড়ো ও বেল ফলের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়।
প্রতিবছর দূরদূরান্ত থেকে হাজার হাজার ভক্ত এসে ভিড় জমান ভবতারিণী মায়ের দর্শনে। ভোর থেকেই গঙ্গাস্নান, প্রদীপ প্রজ্বালন ও ভক্তিগীতের সুরে মুখরিত থাকে সমগ্র মন্দিরচত্বর। মন্দিরের প্রধান পুরোহিত মহারাজ শশাঙ্কচন্দ্র চক্রবর্তী বলেন, “রাণী রাসমণির নির্ধারিত প্রথাগুলি আজও অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হয়। দেবীর সাজ থেকে শুরু করে মন্ত্রোচ্চারণ ও আরতি— সবই সেই পুরনো নিয়মে সম্পন্ন হয়।”
পুজোর অন্যতম আকর্ষণ “রাত্রিকালীন আরতি”, যা অনুষ্ঠিত হয় মধ্যরাতে, দেবীর প্রকৃত আবাহনের সময়। তখন গোটা দক্ষিণেশ্বর জেগে ওঠে ঘণ্টা, শঙ্খ ও ঢাকের গর্জনে। প্রদীপের আলোয় গঙ্গার ঢেউ ঝলমল করে ওঠে, আর ভক্তের ভিড়ে পূর্ণ হয় মন্দিরপ্রাঙ্গণ।
মন্দির কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, এবছরও পুজোর জন্য নেওয়া হয়েছে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পুলিশ, এনডিএফ ও স্বেচ্ছাসেবকরা সারাক্ষণ নজরদারিতে থাকবেন। ভক্তদের সুবিধার্থে আলাদা প্রবেশ ও প্রস্থান পথ রাখা হয়েছে। গঙ্গার ঘাটে বিনামূল্যে প্রসাদ বিতরণের ব্যবস্থাও রয়েছে।
দেবীর অন্নভোগ এই পুজোর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। ভাত, ডাল, তরকারি, পায়েস ও নানা মিষ্টান্ন দিয়ে সাজানো হয় দেবীর সামনে বিশাল ভোগের থালা। প্রথা অনুযায়ী সেই ভোগ নিবেদন শেষে প্রসাদ হিসেবে বিতরণ করা হয় দর্শনার্থীদের মধ্যে।
এই কালীপুজোর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে দক্ষিণেশ্বরের আধ্যাত্মিক ইতিহাস। এখানেই শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বহু বছর ভবতারিণী মায়ের সেবায় ও সাধনায় অতিবাহিত করেছিলেন। তাই কালীপুজোর দিনে তাঁর স্মরণে মন্দির চত্বরে বিশেষ ধ্যান, উপাসনা ও নামসংকীর্তনের আয়োজন করা হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা মৃণালিনী দত্ত বলেন, “দক্ষিণেশ্বরের কালীপুজো শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতি ও পরিচয়ের প্রতীক। এখানে ভক্তি আর ঐতিহ্য মিলেমিশে আছে একাকার।”
গঙ্গার ধারে প্রদীপের আলো, ঢাকের তালে তালের ছন্দে নেচে ওঠা ভক্তের হৃদয়, আর ভবতারিণী মায়ের জ্যোতির্ময় মুখ— সব মিলিয়ে দক্ষিণেশ্বরের কালীপুজো আজও বাঙালির অগাধ বিশ্বাস, আবেগ ও ভক্তির এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।