দেবকিশোর চক্রবর্তী
রাজ্যের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির তালিকায় ‘জয়নগরের মোয়া’-র নাম উচ্চারণ করলেই মুখে জল আসে বাঙালির। শীতের এই বিখ্যাত মিষ্টি এখন শুধুমাত্র উৎসবের আনন্দ নয়, রাজ্যের গর্বও বটে। সেই ঐতিহ্যকে আরও টেকসই এবং আন্তর্জাতিক মানের করে তুলতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবার বড় পদক্ষেপ নিচ্ছে। রাজ্য ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প দফতরের (MSME) উদ্যোগে শিগগিরই জয়নগর ও আশপাশের এলাকায় মোয়া তৈরির জন্য আধুনিক মেশিন বসানো হবে।
সরকারি সূত্রে জানা গেছে, এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য হল জয়নগরের মোয়া শিল্পকে আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত করা। দীর্ঘদিন ধরে হাতে তৈরি মোয়া জয়নগরের কারিগরদের শ্রমে-ঘামে তৈরি হলেও, ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানো কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে, জৈব খেজুরগুড় ও কনকচুরাইয়ের সংমিশ্রণে তৈরি এই মিষ্টি শীতকালের সীমিত সময়ে উৎপাদিত হয় বলে বাজারে সরবরাহের অভাব দেখা দেয়।
মোয়া তৈরির কাজে ব্যস্ত একটি কর্মী
আধুনিক মেশিনের মাধ্যমে মোয়া তৈরির প্রক্রিয়া দ্রুত ও স্বাস্থ্যসম্মতভাবে সম্পন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন উৎপাদন ক্ষমতা বাড়বে, অন্যদিকে শ্রমিকদের পরিশ্রমও অনেকটা কমবে।
জয়নগরের প্রায় ৩০টি মোয়া প্রস্তুতকারক সমবায় সংস্থা ও স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। রাজ্য সরকার প্রতিটি ইউনিটে আধুনিক ‘মোয়া মিক্সিং ও শেইপিং মেশিন’ স্থাপন করবে। পাশাপাশি, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ দফতর ও পঞ্চায়েত মন্ত্রকের যৌথ তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ শিবিরেরও আয়োজন করা হবে, যাতে ঐতিহ্যবাহী স্বাদ বজায় রেখেই আধুনিক পদ্ধতিতে উৎপাদন করা যায়।
স্থানীয় উদ্যোক্তাদের দাবি, এই উদ্যোগে কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ তৈরি হবে। প্রতি ইউনিটে গড়ে ২০–২৫ জন শ্রমিক কাজ পাবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
প্রতীকী ছবি
জানা গেছে, প্রতিটি মেশিনে স্বয়ংক্রিয় তাপমাত্রা ও উপকরণের মিশ্রণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকবে, যাতে জয়নগরের মোয়া-র ঐতিহ্যবাহী গন্ধ, টেক্সচার ও স্বাদ অক্ষুণ্ণ থাকে। উৎপাদিত প্রতিটি ব্যাচ মান নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষার মধ্য দিয়ে বাজারে ছাড়া হবে। রাজ্য সরকার ইতিমধ্যেই ‘জয়নগর মোয়া জিআই (GI) ট্যাগ’-এর অধিকার রক্ষায় বিশেষ নজর দিচ্ছে, যাতে অন্য কোনো অঞ্চলের উৎপাদকরা এই নাম ব্যবহার করে বাজারে ভেজাল পণ্য না আনতে পারে।
স্থানীয় মোয়া প্রস্তুতকারক সঞ্জয় মণ্ডল বলেন, “এখন হাতে তৈরি করতে অনেক সময় লাগে। তাছাড়া শ্রমিক কমছে। মেশিন এলে আমরা দ্রুত কাজ করতে পারব, আবার পুরনো স্বাদও থাকবে যদি গুড় আর খই ভালো হয়।” অন্যদিকে, কিছু প্রবীণ কারিগর শঙ্কা প্রকাশ করেছেন, “মেশিনে বানালে সেই হাতের ছোঁয়া কি থাকবে?” তবে তারা আশাবাদী যে সরকারের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ঐতিহ্য রক্ষা করেই উন্নতি সম্ভব।
মোয়া তৈরি করার একটি দৃশ্য
শুধু রাজ্যেই নয়, বিদেশেও জয়নগরের মোয়া জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। ইতিমধ্যেই রাজ্য সরকার মোয়া-কে ‘বাংলার মিষ্টি ব্র্যান্ড’-এর আওতায় এনে রপ্তানিযোগ্য পণ্য হিসেবে প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছে। নতুন মেশিন ব্যবস্থার ফলে প্যাকেজিং ও সংরক্ষণের মানও উন্নত হবে, যা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশে সহায়ক হবে।
একদিকে জয়নগরের মাটির ঘ্রাণ, অন্যদিকে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া, এই দুইয়ের সমন্বয়েই গড়ে উঠছে নতুন দিগন্ত। সরকারের এই উদ্যোগ সফল হলে ‘জয়নগরের মোয়া’ শুধু শীতের প্রিয় মিষ্টি নয়, রাজ্যের অর্থনীতিতেও এক মিষ্টি অবদান রাখবে বলেই আশা বিশেষজ্ঞদের।