৫১টি সতীপীঠের অন্যতম নলহাটেশ্বরী মন্দিরে কালীপুজো: সতীপীঠে আধ্যাত্মিকতার আবেশ

Story by  Debkishor Chakraborty | Posted by  Sudip sharma chowdhury • 13 d ago
৫১টি সতীপীঠের অন্যতম নলহাটেশ্বরী মন্দির
৫১টি সতীপীঠের অন্যতম নলহাটেশ্বরী মন্দির
 
দেবকিশোর চক্রবর্তী

বীরভূমের রামপুরহাট মহকুমা থেকে প্রায় ১৭ কিলোমিটার দূরে, ব্রাহ্মণী নদীর তীরে অবস্থিত নলহাটেশ্বরী মন্দির। পাথরের টিলা ও ললাট পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এই মন্দিরকে ঘিরে রয়েছে পৌরাণিক কাহিনি ও আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের এক দীর্ঘ ইতিহাস। একাধিক প্রাচীন ধর্মগ্রন্থে উল্লেখ আছে, সতীর দেহাংশ পতনের ফলে যে ৫১টি সতীপীঠের সৃষ্টি হয়েছিল, তার অন্যতম নলহাটি। শাস্ত্রমতে, এখানে সতীর কণ্ঠনালী বা গলার নলি পতিত হয়েছিল। সেই থেকেই স্থানের নাম নলহাটি।

তন্ত্রশাস্ত্রে এই পীঠের গুরুত্ব অপরিসীম। বলা হয়, বিষ্ণুচক্রে কর্তিত সতীর ‘নলা’ বা ‘নুলো’ (অস্থি) এই স্থানে পড়েছিল। তাই দেবী এখানে বিরাজ করছেন নলহাটেশ্বরী রূপে এবং তাঁর ভৈরব স্বরূপ যোগীশ (বা যোগেশ)। আবার কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, সতীর ললাট (কপাল) পতিত হয়েছিল বলে দেবীর নাম ললাটেশ্বরী। এই দ্বৈত নামেই আজও পরিচিত মন্দিরটি। ‘শিবচরিত’ গ্রন্থেও নলহাটিকে ২৬টি উপপীঠের অন্যতম হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

স্থানীয় লোককথা অনুসারে, কামদেব সতীর কণ্ঠনালী এখান থেকেই উদ্ধার করেন। ললাট পাহাড়ের নিচে সেই কণ্ঠনালীর ওপর বেদি স্থাপন করে দেবীর প্রতিষ্ঠা হয়। প্রাচীনকালে এলাকা জঙ্গলবেষ্টিত থাকায় এটি ছিল তান্ত্রিক সাধকদের অন্যতম সাধনক্ষেত্র। রামশরন, বশিষ্ঠ, দেবশর্মা, কুশলানন্দ প্রমুখ সন্ন্যাসীরা এখানে তন্ত্রসাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছেন বলে প্রচলিত আছে। কথিত আছে, বর্গি সর্দার ভাস্কর পণ্ডিতও নিয়মিত এই মন্দিরে পূজা দিতে আসতেন।

জনশ্রুতি অনুযায়ী, প্রায় পাঁচ শতাব্দী আগে রামশরণ শর্মা নামে এক ব্যবসায়ী স্বপ্নাদেশ পান যে দেবী খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছেন। দেবীর আদেশে তিনি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। পরে রানি রাসমনীর উদ্যোগে মন্দিরের বর্তমান রূপ পায়। মধ্যযুগীয় চারচালা শৈলির এই মন্দিরের গর্ভগৃহে বিরাজ করছেন প্রায় চার ফুট উচ্চ পাষাণমূর্তির দেবী। সিঁদুরে রাঙানো মুখমণ্ডল, চাঁদির ছাতা ও স্বর্ণনির্মিত জিহ্বা সহ দেবী কালীর ঐশ্বর্যময় রূপ এখানে স্নিগ্ধ ও শান্ত।

প্রতিদিনই মাকে অন্নভোগ দেওয়া হয়, তবে কালীপুজোর দিনই বিশেষ রাত্রিভোগ হয় দেবীর। সেই রাতে মন্দিরে উপচে পড়ে ভক্তদের ভিড়। দূর্গাপুজোর নবমী ও কালীপুজোর দিন বলিরও প্রথা রয়েছে।

আজ নলহাটেশ্বরী শুধু ধর্মীয় আস্থার কেন্দ্র নয়, এটি বীরভূমের ঐতিহ্যের প্রতীকও। কালীপুজোর সময় সমগ্র এলাকা জেগে ওঠে আলো, ধূপ, মন্ত্রোচ্চারণ ও ঢাকের ধ্বনিতে। হাজারো ভক্তের উপস্থিতিতে দেবী নলহাটেশ্বরীর আরাধনায় মিশে যায় আধ্যাত্মিকতা ও সংস্কৃতির সুর।