মুন্নী বেগম, গুয়াহাটি:
৪০-এর ঘরে এক মহিলা,একজন গৃহিণী,সন্তানের প্রতি গভীর ভালোবাসায় পূর্ণ একজন মা এবং একজন আদর্শ পুত্রবধূ । গুয়াহাটির নাজনীন রহমান জাফর এই সকল পরিচয়ের বাইরে আরও একটি বিশেষ পরিচয় অর্জন করেছেন। তিনি একজন আন্তর্জাতিক টেনিস খেলোয়াড়।তিনি প্রমাণ করেছেন যে সাফল্যের জন্য বয়স কোনো বাধা নয়। তিনি দুই সন্তানের মা, পরিবারের যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি খেলাধুলায়ও নিজেকে নিখুঁতভাবে প্রমাণ করেছেন।
নাজনীন জানান “স্কুলে খেলাধুলা করতাম, কিন্তু পেশাদারভাবে কখনো খেলিনি। কলেজে পড়াশোনার দিকেই মনোযোগ ছিল। বিয়ের পর জীবনের পরবর্তী সময়ে খেলাধুলা শুরু করি।” দশ বছর টেনিস খেলার পর সন্তান ও পরিবারের জন্য বিরতি নেন তিনি।
“আমি ২০১১ সালে টেনিস খেলা শুরু করি এবং পরের বছর রাজ্য স্তরের টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করি। সাফল্যের স্বাদ পেয়ে খেলায় আরও আগ্রহী হই এবং পরে জাতীয় স্তরে প্রশিক্ষণ নিয়ে খেলি,” বলেন জাফর আওয়াজ–দ্য ভয়েস-এ।পরবর্তীতে নাজনীন জাফর আইটিএফ মাস্টার্সে শীর্ষ ১০-এর মধ্যে স্থান করে নেন।
নাজনীন রহমান জাফর খেলার ময়দানে
তিনি বলেন, তার মেয়ে তাকে টেনিস খেলতে অনুপ্রাণিত করেছে। বর্তমানে তার মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের এ অ্যান্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন। “যখন আমি আমার মেয়ে রেইনা জাফরকে টেনিস প্রশিক্ষণের জন্য স্টেডিয়ামে নিয়ে যেতাম, তখন আমিও খেলতে আগ্রহী হই। আমার কয়েকজন বন্ধু বলতেন আমি ভালো খেলি, এবং তারা আমাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভারতীয় রঙে দেখতে চান। তখন ভাবলাম চেষ্টা করে দেখি। অল ইন্ডিয়া টেনিস অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক হরিয়ানায় আয়োজিত আন্তর্জাতিক খেলায় অংশগ্রহণ করি এবং ডাবলসে আমার প্রথম ট্রফি জিতি।”
নাজনীন জাফর ২০২৩ ও ২০২৪ সালে অল অসম সিটিসি মিক্সড ডাবলস শিরোপা জিতেছেন। ২০২৩ সালে দুবাইয়ে বিশ্ব মাস্টার্স টুর্নামেন্ট ২০০-তে রানার-আপ হন, এবং একই বছরে গুয়াহাটি, দার্জিলিং ও গুরগাঁওতে মাস্টার্স টুর্নামেন্টে শিরোপা জিতেছেন।তিনি থাইল্যান্ডে মাস্টার্স ৪০০ টুর্নামেন্টেও ডাবলসে শিরোপা জিতেছেন।
“আমি ধীরে ধীরে আরও টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করতে শুরু করি এবং আমার র্যাঙ্কিং উন্নত হয়। তারপর যখন ভারত বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে নারী দলের জন্য খেলোয়াড় পাঠায়, তখন আমাকে অধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।”তিনি প্রথমবারের মতো মহিলা টেনিস দলকে পর্তুগালে নিয়ে যান। “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, আমাদের দলে প্রত্যেক খেলোয়াড় মা ছিলেন। সন্তানের পর নিজস্ব পরিচয় গড়ে তোলা খুব গর্বের বিষয়।”
নাজনীন তাঁর মেয়েদের সাথে
নাজনীন সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেছেন যে সন্তান জন্মের পর মহিলাদের শারীরিক ফিটনেস বজায় রাখা কঠিন। তিনি একজন ক্রীড়াবিদ এবং সক্রিয় ফিটনেস ইনফ্লুয়েন্সার।
“আমি মনে করি খেলাধুলা ও শরীরচর্চা একে অপরের পরিপূরক। আমি যখন আমার মেয়েকে বিভিন্ন জায়গায় খেলাধুলার জন্য নিয়ে যেতাম, তখন তাকে ফিট রাখার জন্য অনেক বিষয়ে খেয়াল রাখতে হতো। সবসময় ফিটনেস কোচ সঙ্গে নেওয়া খরচসাপেক্ষ, তাই আমি নিজেই শিখেছি কীভাবে ফিট থাকা যায় এবং কীভাবে একজন টেনিস খেলোয়াড় তার ফিটনেস বজায় রাখতে পারে।”
“সন্তান জন্মের পর আমার বয়সী অনেক মহিলার জন্য ফিট থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। অনেকে নিজের যত্ন নেওয়া ছেড়ে দেন। কিন্তু আমি মনে করি প্রতিটি মহিলার নিজের যত্ন নেওয়া উচিত – কেবল খেলাধুলার জন্য নয়, বরং শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য। হাঁটা এবং যোগব্যায়াম অবশ্যই করা উচিত। ৩০ বছর বয়সের পর মহিলাদের পেশি গঠনের হার ধীর হয়ে যায়। ৪০ বছর বয়সে মেনোপজের সময়ে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়।”
“এই সব কিছুর মোকাবিলা করতে ফিট থাকা জরুরি। অনেক মহিলা একটা সময়ের পর বলেন, আমরা এটা পারি না, সেটা পারি না। কিন্তু আমি মনে করি শেখার কোনো নির্দিষ্ট বয়স নেই। এমনকি যদি আত্মবিশ্বাস ও ইচ্ছা থাকে ৮০ বা ৯০ বছরের মহিলারা অনেক কিছু করতে পারেন । আমি যখন খেলা শুরু করি তখন আসামে খুব কম মহিলারাই খেলতেন, কিন্তু এখন অনেক মহিলা খেলছেন,” বলেন নাজনীন।
“আমি খানাপাড়া ময়দানে বিনামূল্যে যোগব্যায়াম প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। আমি মনে করি শারীরিক ফিটনেসের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যেও গুরুত্ব দেওয়া দরকার। মানসিকভাবে সুস্থ থাকলে আমরা সুখে থাকি এবং অন্যদেরও সুখে রাখতে পারি, সমস্যার মোকাবিলা করতে পারি। যখন পরিবারের অন্য সদস্যরা মহিলাদের এই পরিবর্তন দেখেন, তখন তারাও বদলাতে চান,” বলে জানান এই ফিটনেস ইনফ্লুয়েন্সার।
অনেক সময় একজন মহিলা, বিশেষ করে মুসলিম মহিলা, ঘরের বাইরে যাওয়াকে ঝামেলা মনে করেন। তবে একজন মুসলিম মহিলা হিসেবে নাজনীন জাফর কখনো বাধার মুখে পড়েননি, বরং পরিবারের কাছ থেকে সবসময় সমর্থন পেয়েছেন।
“আমার পরিবার থেকে অনেক সমর্থন পাই। ছোটবেলায় বাবা এবং পরে আমার স্বামী শাহনওয়াজ জাফর আমাকে সমর্থন করেছেন। তিনি একজন এনআইএস স্বীকৃত টেনিস কোচ। খেলায় বিভিন্ন বিষয়ে তিনি আমাকে গাইড করেন। অনেক মহিলা, বিশেষ করে মুসলিম মহিলা, বাইরে যেতে অনিচ্ছুক। আমি ভাগ্যবান যে আমার পরিবার আমাকে আর্থিক এবং মানসিকভাবে সমর্থন করে।”
নাজনীন খেলাধুলাকে ধর্ম এবং আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে যুক্ত করেন। “আমি নিয়মিত নামাজ পড়ি এবং রোজা রাখি, শুধুমাত্র খেলার সময় কিছু ব্যতিক্রম ঘটে। যখন খেলতে বাইরে যাই তখন একা রুমে থাকি যাতে ধর্মীয় কাজকর্ম নির্বিঘ্নে করতে পারি। ধর্ম আমাদের শরীর সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। আমরা এক মাস রোজা রাখি, যা একটি ইতিবাচক অনুশীলন এবং এর পেছনে অনেক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে, বিশেষ করে একজন ক্রীড়াবিদের জন্য,” বলেন তিনি।
নাজনীন বলিউড অভিনেত্রী গুলের সাথে
খেলার সময় একজন খেলোয়াড়কে ভালো-মন্দ নানা পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। এই পরিস্থিতিতে মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখা ক্রীড়াজীবনের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। নাজনীন জাফর খেলোয়াড় এবং ফিটনেস ইনফ্লুয়েন্সার হিসেবে স্পোর্টস সাইকোলজির কোর্স করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি অনেক খেলোয়াড়কে মানসিকভাবে স্থির থাকতে পরামর্শ দেন।
“আমি স্পোর্টস সাইকোলজির কোর্স করেছি। টেনিস খুব কঠিন খেলা। অনেক ভালো ও খারাপ অভিজ্ঞতা হয়। যেহেতু আমার মেয়ে ও ছেলে আমার সঙ্গে খেলে, আমি এই কোর্স করেছি,” বলেন তিনি।
“আমি আমার সন্তানদের মানসিকভাবে স্থির রাখতে সাহায্য করতে পেরেছি। আমি অন্যান্য খেলোয়াড়দেরও পরামর্শ দিই। এই কোর্স শেখায় কীভাবে হেরে যাওয়ার পর নিজেকে সামলাতে হয় এবং কীভাবে দৃঢ় থাকতে হয়। যেমন, কোর্টে ঢোকার মুহূর্তে আমাকে ঠিক করতে হয় যে আমি যেভাবেই হোক জিতব। এটি দর্শকদের প্রত্যাশা পূরণে সহায়তা করে,” তিনি ব্যাখ্যা করেন।
সাম্প্রতিক সময়ে নাজনীন আসামে তুলনামূলকভাবে নতুন একটি খেলা প্রচার করছেন – পিকলবল।
“পিকলবল এখন আসামে দ্রুত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এটি আমেরিকা ও এশিয়ার দেশগুলোতেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। ভারতে এর প্রসার দ্রুতগতিতে ঘটছে। খেলাটি খুবই সহজ ও সুবিধাজনক। এতে কঠোর কোনো নিয়ম নেই। এটি মূলত টেনিস, টেবিল টেনিস এবং ব্যাডমিনটনের সংমিশ্রণ এবং যেকোনো বয়সের মানুষ এটি খেলতে পারে। একটি পলিমারের বল দিয়ে ফাইবার, মাইক্রোফাইবার এবং কাঠের তৈরি ছোট প্যাডেল ব্যবহার করে খেলা হয়। আমরা এই খেলাটি আসামে এনেছি। সম্প্রতি আমরা এটি কয়েকটি স্কুল এবং আইএএস কলোনিতে প্রদর্শন করেছি এবং দারুণ সাড়া পেয়েছি।”
ভারতের ২৩টি রাজ্যে ইতিমধ্যে পিকলবল চালু হয়েছে। এনসিআর, দিল্লি এনসিআর এবং পশ্চিম ভারতে নতুন নতুন কোচ উঠে আসছেন এবং প্রায় ১০,০০০ খেলোয়াড় ইতিমধ্যে রেজিস্টার হয়েছেন। সম্প্রতি দুবাইয়ে “পিকলবল ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিং” নামে একটি প্রতিষ্ঠান চালু হয়েছে।