সিবিআইকে অসাংবিধানিক বললেন প্রাক্তন বিচারপতি ইকবাল আহমেদ আনসারি জীবনের অনেক অজানা কথা

Story by  atv | Posted by  Sudip sharma chowdhury • 7 d ago
প্রাক্তন বিচারপতি ইকবাল আহমেদ আনসারি
প্রাক্তন বিচারপতি ইকবাল আহমেদ আনসারি

 


ইমতিয়াজ আহমেদ ,তেজপুর

এক দশক আগে,প্রায় তিনদিন ধরে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা সিবিআই কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছিল এবং সংস্থাটির অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে অভিযুক্ত বহু ব্যক্তি আদালতে তাঁদের মামলার স্থগিতাদেশ চেয়েছিলেন। এই পরিস্থিতির উদ্ভব হয় ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে গৌহাটি উচ্চ আদালতের একটি ঐতিহাসিক রায়ে সিবিআইকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করার কারণে। সিবিআইকে অসাংবিধানিক বলার কারণ ছিল,সংস্থাটি প্রতিষ্ঠার জন্য কোনো সাংবিধানিক ব্যাবস্থা,মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত বা রাষ্ট্রপতির অনুমোদন ছিল না।
 
বিচারপতি ইকবাল আহমেদ আনসারি ও বিচারপতি ইন্দিরা শাহের সমন্বয়ে গঠিত গৌহাটি উচ্চ আদালতের একটি ডিভিশন বেঞ্চ ১৯৬৩ সালের ১ এপ্রিল দিল্লি স্পেশাল পুলিশ এস্থাবলিশমেন্ট অ্যাক্ট,১৯৪৬-এর অধীনে সিবিআই গঠনের সিদ্ধান্ত বাতিল করে এবং এর সব কার্যকলাপ অসাংবিধানিক ঘোষণা করে। তবে,২০১৩ সালের ৯ নভেম্বর তৎকালীন ভারতের প্রধান বিচারপতি পি.সতাশিবম এবং বিচারপতি রঞ্জনা দেশাইয়ের একটি বেঞ্চ একটি বিশেষ বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তে গৌহাটি উচ্চ আদালতের এই রায়ের উপর স্থগিতাদেশ জারি করে। সেই থেকে আজ অবধি এই বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টে মীমাংসিত হয়নি।

গৌহাটি উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী,সিবিআই কোনো আইনগত ভিত্তিতে গঠিত হয়নি। এটি গঠিত হয়েছিল কেবলমাত্র ১৯৬৩ সালে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি কার্যনির্বাহী আদেশের মাধ্যমে,যা সংবিধানসম্মত নয়।এই রায় ভারতীয় বিচারব্যবস্থায় এক প্রকার আলোড়ন ও কৌতূহলের সৃষ্টি করেছিল এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে তৎক্ষণাৎ বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টে উত্থাপন করতে বাধ্য করেছিল। এই ঐতিহাসিক রায়দানকারী বিচারপতি (অবসরপ্রাপ্ত) ইকবাল আহমেদ আনসারি সম্প্রতি ‘আওয়াজ - দ্য ভয়েস’-এ একটি একান্ত সাক্ষাৎকারে তাঁর আইনি জীবনের বহু অজানা তথ্য ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। পরে তিনি পাটনা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং পাঞ্জাব মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।এই রায় নিয়ে বিচারপতি আনসারীর ক্ষোভ,আজও অমীমাংসিত  একটি গুরুতর বিষয়।এই রায় প্রসঙ্গে মন্তব্য করে বিচারপতি ইকবাল আহমেদ আনসারি আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন,এমন একটি গুরুতর বিষয় আজও অমীমাংসিত অবস্থায় পড়ে আছে। তাঁর মতে, সরকার এ বিষয়ে নিষ্পত্তির কোনো সদিচ্ছা দেখায়নি,কারণ এর মাধ্যমে দেশের শীর্ষ তদন্ত সংস্থা সিবিআই যে হাজার হাজার মামলার তদন্ত করেছে,তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
 

 
প্রাক্তন বিচারপতি ইকবাল আহমেদ আনসারি
 
বিচারপতি আনসারি বলেন, “এই মামলাটি শুরু হয়েছিল ২০০৭ সালে, যখন বিএসএনএল-এর এক কর্মচারী বিচারপতি রঞ্জন গগৈ (যিনি পরবর্তীতে ভারতের প্রধান বিচারপতি হন) প্রদত্ত এক রায়ের বিরুদ্ধে সিবিআই-এর সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ জানিয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। আমি এবং বিচারপতি ড.ইন্দিরা শাহ মামলাটি পর্যালোচনা করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাই যে, সিবিআই সংবিধানসম্মতভাবে গঠিত হয়নি,বরং এটি গঠিত হয়েছিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি কার্যনির্বাহী প্রস্তাবের মাধ্যমে। এরপর বিষয়টি উচ্চতম আদালতে গড়ায়,যেখানে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি পি. সতাশিবমের নেতৃত্বাধীন অবকাশকালীন বেঞ্চ গৌহাটি হাইকোর্টের রায় স্থগিত করে। ২০১৩ সালের ৬ ডিসেম্বর যখন মামলাটি আবার শুনানির জন্য তোলা হয়, তখন দুই বিচারপতির বেঞ্চে থাকা বিচারপতি রঞ্জন গগৈ নৈতিক কারণে নিজেকে মামলাটি থেকে সরিয়ে নেন। তারপর থেকে নতুন কোনো বেঞ্চ গঠিত হয়নি,যার ফলে আজও বিষয়টি অনিষ্পন্ন রয়ে গেছে।”

বিচারপতি আনসারি আরও উল্লেখ করেন,“বিচারপতি জে.চালামেশ্বর এবং বিচারপতি মদন লোকুরের মতো অন্যান্য বিচারপতিরাও সময়ে সময়ে বলেছেন যে,সুপ্রিম কোর্টের উচিত এই বিষয়ে চূড়ান্ত রায় দেওয়া। কারণ,যদি সিবিআই অসাংবিধানিক বলে গণ্য হয়,তাহলে এত বছর ধরে যেসব মামলার তদন্ত সিবিআই করেছে,সেগুলির ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়বে।”

এই রায়ের কারণে বিচারপতি আনসারীর পেশাগত জীবনের উপরও প্রভাব পড়ে। তিনি বলেন,“সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বা কোনো হাইকোর্টের বিচারপতি ও প্রধান বিচারপতি কে হবেন,তা নির্ধারণ করে কলেজিয়াম। দুর্ভাগ্যজনকভাবে একজন অসমীয়াই আমার উন্নয়ন বা পদোন্নতির পথে বাধা দিয়েছিলেন। বিচারপতি রঞ্জন গগৈ পাটনা হাইকোর্টে আমাকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার বিরোধিতা করেছিলেন,কারণ আমার সিবিআই সম্পর্কিত রায়টি তাঁর আগের এক রায়ের বিরোধী ছিল। ভারতের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি টি. এস. ঠাকুর আমাকে বলেছিলেন যে,যখন আমার নাম পাটনা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির জন্য প্রস্তাবিত হয়,তখন বিচারপতি গগৈ তাতে আপত্তি জানান। বিচারপতি ঠাকুর যখন বিষয়টি কলেজিয়ামের কাছে পাঠান, তখন গগৈ আমাকে পাটনার পরিবর্তে মেঘালয় হাইকোর্টে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার জন্য জোর দেন। কিন্তু বিচারপতি ঠাকুর বিচারপতি গগৈকে আহ্বান জানান যে, আমার বিরুদ্ধে তাঁর যদি কোনো অভিযোগ থাকে, তা লিখিতভাবে দাখিল করুন। শেষ পর্যন্ত বিচারপতি গগৈ স্বীকার করতে বাধ্য হন যে, তাঁর কাছে আমার বিরুদ্ধে কোনো যথাযথ তথ্য নেই।”
 

 
প্রাক্তন বিচারপতি ইকবাল আহমেদ আনসারি প্রাক্তন বিচারপতি টি এস ঠাকুরের সাথে
 
 
সিবিআই সংক্রান্ত রায় ছাড়াও অন্যান্য বহু রায়ে গর্ব অনুভব করেন বিচারপতি আনসারি।সিবিআই সম্পর্কে দেওয়া ঐতিহাসিক রায়ের পাশাপাশি বিচারপতি ইকবাল আহমেদ আনসারি তাঁর কিছু অন্যান্য রায় নিয়েও গভীর সন্তুষ্টি অনুভব করেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিল,এনআইএ মামলার অভিযুক্তদের হাইকোর্টে আবেদন করার আগে বিশেষ আদালতে হাজিরা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা সংক্রান্ত রায়, আসামের জনসাধারণের জন্য ক্ষতিকর বলে কয়লা ইন্ডিয়া লিমিটেড-এর ই-নিলাম ব্যবস্থা বাতিল, ধর্ষণের শিকার এক তরুণীর অনুরোধে তার গর্ভপাতের অনুমতি দেওয়ার নির্দেশ।

বিচারপতি হওয়ার পথে তাঁর যাত্রা

উত্তর আসামের নিজের শহর তেজপুরে পড়াশোনা করা বিচারপতি আনসারি শুরুতে ইঞ্জিনিয়ার বা সেনা অফিসার হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর ব্যারিস্টার পিতা তাঁকে আইনজীবী হওয়ার পথে উৎসাহিত করেন। তিনি বলেন,"আমার ইঞ্জিনিয়ারিং-এর প্রতি গভীর আগ্রহ ছিল, কারণ আমাদের সময়ে এতে ভালো সুযোগ ছিল। কিন্তু বাবার ধারণা ছিল, ইঞ্জিনিয়াররা অতিরিক্ত রোজগার করে এবং তাদের মধ্যে জুয়া ও মদ্যপানের প্রবণতা থাকে। সে কারণে তিনি চাইতেন আমি আইন পড়ি। প্রথমে আমার মনে হয়েছিল, আইনজীবীদের অনেক মিথ্যে বলতে হয়। কিন্তু পরে বুঝলাম, এটি ঠিক নয়। একজন আইনজীবী চাইলে মিথ্যা না বলেই মামলা পরিচালনা করতে পারেন।"

তিনি আরও বলেন,"আমি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চেয়েছিলাম এবং নির্বাচিতও হয়েছিলাম। কিন্তু বাবা বলেছিলেন, আমি যেহেতু জেদি ও রাগী, সেনাবাহিনীতে গেলে হয়তো কোর্ট মার্শাল হয়ে বরখাস্ত হব। তখন আমি সেনাবাহিনীর স্বপ্ন ছেড়ে দিয়ে আইনজীবী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আইনি জীবনে কিছু বিচারপতির ব্যক্তিত্ব আমাকে অনুপ্রাণিত করে, যেমন বিচারপতি এস এন ফুকন। এরপর আমি বিচার বিভাগে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নিই এবং প্রথম প্রচেষ্টাতেই সফল হই।"
 
বিচার বিভাগে রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক চাপ সম্পর্কে তাঁর অভিমত
 
“বিচার বিভাগ কি কখনো রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক চাপে পড়ে?” — এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি স্পষ্ট বলেন,
“আমার সময়ে এমন কোনো চাপ ছিল না। তবে প্রশাসন কখনো কখনো চাপ প্রয়োগ করতে পারে, আর সেটা বিচারকের উপর নির্ভর করে। যদিও আজকাল বিচারপতি অজিত পি শাহ, বিচারপতি মদন লোকুর, বিচারপতি জোসেফ কুরিয়ানের বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, সুপ্রিম কোর্ট পর্যায়ের বিচার ব্যবস্থাও আজকাল বিভিন্ন চাপের সম্মুখীন হচ্ছে। এমন কিছু ঘটনার সাক্ষী হওয়া গেছে যেখানে বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হয়েছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে আমি এখনো মনে করি বিচার বিভাগ স্বাধীন।”
 
কলকাতায় সেমিনারে প্রাক্তন বিচারপতি
 
ভারতের বিচার ব্যবস্থায় বিচারাধীন মামলার সংখ্যা একটি বড় সমস্যা

তিনি বলেন,“এটি একটি জটিল সমস্যা। ভারতে বিচারক ও মামলার অনুপাত বাংলাদেশ থেকেও খারাপ। এই সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের আরও বেশি আইন কলেজ দরকার। সুপ্রিম কোর্ট আইন স্নাতকদের কর্পোরেট সেক্টরে যাওয়া ঠেকাতে সরাসরি বিচার বিভাগে প্রবেশের সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু সেখানেও ফল বিশেষ দেখা যাচ্ছে না, কারণ এতে সঠিক প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে।”

প্রশিক্ষণমূলক উদ্যোগ এবং ভবিষ্যৎ অভিপ্রায়


গৌহাটি হাইকোর্টে থাকাকালীন বিচারপতি আনসারি কিছু প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন,“আমি খুশি যে অনেক তরুণ আইনজীবী এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে উপকৃত হয়েছে এবং এদের মধ্যে অনেকে এখন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী হিসেবে ভালো কাজ করছে, যা আমাকে আত্মতুষ্টি দেয়। এখনো যদি আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়, আমি এ ধরনের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে প্রস্তুত।”